বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগ
মধ্যযুগ (১২০১-১৮০০ খ্রিঃ)
১২০১ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হিসেবে ধরা হয়। মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। অর্থাৎ ধর্মীয় আবেশে এযুগে সাহিত্য রচিত হত। ফলে এ
যুগের সাহিত্যে দেব-দেবীর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া এযুগের সাহিত্য ছিল
প্রধানত পদ্য ও গীতি নির্ভর। গদ্য সাহিত্য
তখনও প্রসার লাভ করে নি বা পরিচিতি পায় নি।
১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কতৃক নদীয়া
বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয়। উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য
রচিত না হওয়ায় মধ্যযুগের ১২০১-১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে অনেক পণ্ডিত বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহ্নিত
করেছেন। রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ এবং হলায়ুধ
মিশ্রের “সেক শুভোদয়া” ছাড়া এসময়কালের
তেমন কোন প্রধান সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় নি।
মধ্যযুগের কাব্যের প্রধান
৪টি ধারা লক্ষ্য করা যায়। যথা: মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, রোমাঞ্চধর্মী
প্রণয়োখ্যান ও অনুবাদ সাহিত্য।
মধ্যযুগের শ্রেণীবিভাগ
চৈতন্যদেবের (বা চৈতন্য মহাপ্রভু) জীবনীর ভিত্তিতে মধ্যযুগকে তিন ভাগে ভাগ
করা যায়। যথা-
ó প্রাকচৈতন্য যুগ
(১২০১-১৫০০ খ্রি.)
ó চৈতন্য যুগ ( ১৫০১
– ১৬০০ খ্রি.)
ó চৈতন্য পরবর্তী যুগ
(১৬০১ – ১৮০০ খ্রি.)
মুসলিম শাসনামলের ভিত্তিতে
মধ্যযুগকে ৩ অংশে ভাগ করা যায়। যথা-
ó তুর্কি যুগ (১২০১-১৩৫০
খ্রি.)
ó সুলতানি যুগ (১৩৫১-১৫৭৫
খ্রি.)
ó মোঘল যুগ (১৫৭৬-১৭৫৭
খ্রি.)
তবে সাধারণভাবে মধ্যযুগকে
নিম্নোক্ত তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
ó আদি-মধ্যযুগ (১২০০-১৩৫০)
বা অন্ধকার যুগ
ó মধ্য-মধ্যযুগ (১৩৫০-১৭০০)
এবং
ó অন্ত্য-মধ্যযুগ
(১৭০০-১৮০০)
আদি-মধ্যযুগ বা অন্ধকার যুগ
১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ
পর্যন্ত ১৫০ বছর সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলা হয়। সম্ভবত এ যুগে
মুসলমান ও তুর্কি আক্রমনের কারণে কবি-সাহিত্যিকগণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতেন।
ধারণা করা হয় এ কারণেই কবি-সাহিত্যিকগণ উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য রচনা করতে পারেননি।
তবে বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগের অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক পণ্ডিতই
অন্ধকার যুগকে স্বীকার করেন না। ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের ভাষায় বাংলা সাহিত্যের
তুর্কিযুগ প্রধানত ভাষা গঠনের কাল। বাঙ্গালীর মন এ সময়ে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজেছে
নদীর ধারার মতো এঁকে-বেঁকে। নিজের পথ নিজের ভাষার খাতে কেটে চলেছে।
বাংলা সাহিত্যে তুর্কি
বিজয়ের প্রভাব সম্পর্কে ড. আহমদ শরীফ এর মূল্যায়ন-
তুর্কীর ধর্ম, মনন ও
সংস্কৃতির প্রভাবে যে নতুন চিন্তা চেতনার লাবণ্য এ দেশে দেখা গেল তা ছিল ব্যাপক ও
গভীর-ভক্তিবাদ, সন্ত ধর্ম-প্রেমবাদ তারই প্রসুন। তাতে বিজ্ঞান, জ্ঞান, বুদ্ধি ও
উচ্চমার্গের তাত্ত্বিক চেতনা ছিল, ছিল মানবতার ও সংবেদনশীলতার স্নিগ্ধতা। সেদিন নিজির্ত-নিপীড়িত
নির্বিত্ত নিম্নবর্ণের মানুষের মনে মুক্তি আক্ষা ও দ্রোহের সাহস জাগিয়ে ছিল। ফলে
মানুষের জীবনে জীবিকায় উন্মুক্ত হলো সম্ভাবনার অসীম দিগন্ত। তুর্কী প্রভাবে দেশী
মানুষের চিন্তা চেতনায় যে বিপ্লব এলো তাতে ভারতীয় জীবন জিজ্ঞাসায় ও জগত ভাবনায়
যুগান্তর ঘটিয়েছিল।
ড. আহমদ শরীফ
এযুগের উল্লেখযোগ্য
সাহিত্যকর্ম হল রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ ও হলায়ুধ মিশ্রের ‘সেক শুভদয়া’।
প্রাকৃত পৈঙ্গল
আন্ধকার যুগের প্রথম
সাহিত্য নিদর্শন প্রাকৃত পৈঙ্গল। এটি প্রাকৃত ভাষায় রচিত গীতি কবিতার গ্রন্থ। গ্রন্থটি মূলত বিভিন্ন কবির শ্লোকের
সংকলন। এর রচয়িতা শ্রীহর্ষ।
শূন্যপুরাণ
শূন্যপুরাণ রমাই পণ্ডিত
রচিত ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ। এটি গদ্য-পদ্য
মিশ্রিত চম্পুকাব্য। এতে শূন্যময় দেবতা ধর্মঠাকুরের পূজা পদ্ধতির
বর্ণনা রয়েছে। ধর্মপূজার বিবরণে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদ ও হিন্দু লোকধর্মের মিশ্রণ
ঘটেছে। এ গ্রন্থে ধর্মদেবতা নিরঞ্জনের যে কল্পনা করা হয়েছে তা বৌদ্ধদের
শূন্যবাদের অনুরূপ।
শূন্যপুরাণ গ্রন্থটি ৫১টি অধ্যায়ে বিভক্ত যার
প্রথম ৫টিতে সৃষ্টিতত্ত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থের পরের ৪৬টি অধ্যায়ে
ধর্মপূজার রীতি-পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। শূন্যপুরাণ
আবিষ্কার করেন নগেন্দ্রনাথ বসু। “নিরঞ্জনের
উষ্মা” – শূন্যপুরাণ কাব্যের অন্তর্গত একটি কবিতা।
এতে ব্রাহ্মণ্য শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসনের কথা বলা হয়েছে।
সেক শুভোদয়া
অশুদ্ধ বাংলা ও সংস্কৃত
ভাষার মিশ্রণে রচিত একটি গ্রন্থ হল সেক শুভোদয়া। শেখের
শুভদয়া বা শেখদের শুভ আগমন বা মহাত্ম্য বর্ণনা করাই এ কব্যের মূল উপজীব্য। ১৯১৩-১৪
সালে মণীন্দ্রমোহন বসু গ্রন্থটির ১৩টি অনুচ্ছেদ বঙ্গানুবাদসহ কায়স্থ পত্রিকায়
প্রকাশ করেন। ১৯২৭ সালে গ্রন্থটি সুকুমার সেনের সম্পাদনায় প্রথম মুদ্রিত হয়।
গদ্য-পদ্য মিলিয়ে গ্রন্থটিতে ২৫টি অধ্যায় রয়েছে।
অন্ধকারযুগ পরবর্তী
মধ্যযুগের সাহিত্যকর্মগুলোকে ভাষাবিদগণ দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:
- মৌলিক সাহিত্য: উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য।
- অনুবাদ সাহিত্য: উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে রামায়ণ, মহাভারত, ভগবত ইত্যাদি।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যর
প্রধান দুটি শাখা: কাহিনীমূলক ও গীতিমূলক। কাহিনীমূলক রচনায় কাহিনী বা গল্পটিই
প্রাধান্য পায় এবং গীতিমূলক রচনায় ছন্দের প্রাধান্য থাকে।
প্রাকচৈতন্য যুগ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
সাধারণত খ্রিস্টীয় ১৩-১৪শ
শতক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগ বা চৈতন্যপূর্ব যুগ বলে চিহ্নিত করা হয়।
এ সময়ের বাংলা সাহিত্য তিনটি প্রধান ধারায় বিকশিত হয়েছে। যথা: বৈষ্ণব সাহিত্য,
মঙ্গল সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্য।
মধ্যযুগের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ
নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি রচনা করেন বড়ু চণ্ডীদাস। ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লার
মতে কাব্যটির রচনাকাল ১৪০০ খ্রি.। বাংলা সাহিত্যের
সর্বজন স্বীকৃত ও খঁটি বাংলায় রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য।
১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের
বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক এক ব্রাহ্মণের
বাড়ির গোয়ালঘর থেকে এই পুথিটি উদ্ধার করেন। প্রাচীন পুথিগুলিতে সচরাচর প্রথম বা
শেষ পাতায় পুথির নাম লেখা থাকে। কিন্তু প্রাপ্ত পুথিটির মাঝখানের এবং শেষের
কয়েকটি পাতা না থাকায় এর নাম জানা যায়নি। তবে পুঁথির সাথে পাওয়া একটি চিরকুট
অনুসারে এ কাব্যের নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। বসন্তরঞ্জন রায় কাব্যটির নাম দেন
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। তার সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে কাব্যটি
প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য বসন্তরঞ্জন রায়-এর উপাধি ছিল বিদ্বদ্বল্লভ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যেটিতে
মোট খণ্ড ১৩টি ও পদ ৪১৮টি। এটি পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত। কাব্যের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণ, রাধা ও বড়াই। বড়াই
রাধাকৃষ্ণের প্রেমের দূতি।
ভগবান বিষ্ণুর অবতাররূপে
কৃষ্ণের জন্ম। বৃন্দাবনে বড়াইয়ের সহযোগিতায় রাধার সঙ্গে তার প্রণয় এবং শেষে
বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ।
– ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’
কাব্যের মূল উপজীব্য।
গঠন নৈপুন্যের দিক থেকে
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অধিকাংশ পদই কৃষ্ণ, রাধা ও বড়াইয়ের সংলাপ। তাই গঠনরীতি
অনুসারে কাব্যটি মূলত নাট্যগীতি।
বৈষ্ণব সাহিত্য
বৈষ্ণব সাহিত্য দুইটি ধারায়
বিভক্ত। যথা: বৈষ্ণব পদাবলি ও জীবনী সাহিত্য।
বৈষ্ণব পদাবলি
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বৈষ্ণব পদাবলি। বৈষ্ণব সমাজে এটি মহাজন পদাবলি নামেও পরিচিত। এ পদগুলোর সৃষ্টি হয়েছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা
অবলম্বনে। এর অধিকাংশ পদ ব্রজবুলি নামক কৃত্রিম কবিভাষায় রচিত। ব্রজবুলি মূলত
বাংলা ও মৈথিলী ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্ট ভাষা।
বাংলা সাহিত্যের একজন
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ত্ব শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছেন। তার
প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মকে উপজীব্য করেই বৈষ্ণব পদকর্তারা পদাবলি রচনা করেন। মূলত
বৈষ্ণব পদাবলি হল বৌদ্ধ বা বৈষ্ণবীয় ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব বিষয়ক সৃষ্ট পদ।
ó বৈষ্ণব পদাবলির আদিকবি
বিদ্যাপতি (অবাঙালি)।
ó বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব
পদাবলির আদি রচয়িতা / প্রথম কবি চণ্ডীদাস। এছাড়া বৈষ্ণব পদাবলির উল্লখযোগ্য কবি- জ্ঞানদাস,
গোবিন্দদাস, বলরাম দাস প্রমূখ।
ó কবি জয়দেবকে সংস্কৃত ভাষায় বৈষ্ণব
পাবলির প্রথম কবি বলা হয়।
ó বৈষ্ণব পদাবলি সংকলন
করেন বাবা আউয়াল মনোহর দাস। ষোড়শ শতকের শেষার্ধে তিনি তার ‘পদসমুদ্র’ গ্রন্থে বৈষ্ণব
পদাবলি সংকলণ করেন।
বিখ্যাত উক্তি –
ó এ সখি হামারি দুখের
নাহি ওর, এ ভরা বাদর মাহ বাদর, শূন্য মন্দির মোর – বিদ্যাপতি
ó সবার উপরে মানুষ
সত্য তাহার উপরে নাই – চণ্ডীদাস
ó সুখের লাগিয়া এ
ঘর বাধিনু, অনলে পুড়িয়া গেল – জ্ঞানদাস
ó রূপ লাগি আঁখি জ্বরে
গুণে মন ভোর – জ্ঞানদাস
চণ্ডীদাস সমস্যা: মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চারজন চণ্ডীদাসের (বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ
চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস) অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু তারা প্রত্যকেই
পৃথক ব্যক্তি নাকি একই ব্যক্তি একাধিক নাম ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। যেমন
অনেক পণ্ডিত দ্বিজ চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাসকে একই ব্যক্তি মনে করেন। উক্ত চারজন
কবির অস্তিত্ব নিয়ে যে অস্পষ্টতা তাই চণ্ডীদাস সমস্যা নামে পরিচিত।
আরো পড়ুনঃ বাংলা সাহিত্য প্রাচীন যুগ
জীবনী সাহিত্য
কোন বিখ্যাত ব্যক্তির
জীবনীকে উপজীব্য করে যে সাহিত্য রচিত হয় তাই জীবনী সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের একজন
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ত্ব শ্রীচৈতন্যদেব। সাহিত্যের একটি পদ রচনা না করেও তার নামে
একটি যুগের সূচনা হয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেবের পিতৃপ্রদত্ত নাম বিশ্বম্ভর মিশ্র এবং ডাক নাম নিমাই। তার জীবনী অবলম্বনে বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনী সাহিত্য
রচিত হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী গ্রন্থকে বলা হয় কড়চা। ১৫০০-১৭০০
খ্রিস্টাব্দকে বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যযুগ বলা হয়।
উল্লেখযোগ্য জীবনী গ্রন্থ-
রচয়িতা |
গ্রন্থের নাম |
তথ্য |
মুরারিগুপ্ত |
শ্রী শ্রী কৃষ্ণ চৈতন্য চরিতামৃত |
শ্রীচৈতন্যদেবের
প্রথম জীবনী কাব্য। এর অন্য নাম ‘মুরারী গুপ্তের কড়চা’। |
বৃন্দাবন দাস |
শ্রীচৈতন্যভগবত |
বাংলায়
শ্রীচৈতন্যদেবের প্রথম জীবনী কাব্য। |
লোচন দাস |
চৈতন্য মঙ্গল |
|
কৃষ্ণদাস কবিরাজ |
চৈতন্যচরিতামৃত |
সর্বাপেক্ষা
তথ্যবহুল জীবনী কাব্য। শ্রীচৈতন্যদেবের শ্রেষ্ঠ জীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ। |
অন্যান্য জীবনী সহিত্য-
রচয়িতা |
গ্রন্থের নাম |
তথ্য |
সৈয়দ সুলতান |
নবী বংশ, শব-ই-মিরাজ, রাসূল
বিজয় |
|
হরকৃষ্ণ দাস |
বাল্যলীলাসূত্র |
বৈষ্ণব
ধর্মের অন্যতম প্রধান অদ্বৈত আচার্যের জীবনী নিয়ে লেখা। |
ঈশান নাগর |
অদ্বৈতপ্রকাশ |
বাংলায়
অদ্বৈত আচার্যের জীবনী নিয়ে লেখা প্রথম গ্রন্থ। |
হরিচরণ দাস |
অদ্বৈতমঙ্গল |
মঙ্গলকাব্য
মঙ্গলকাব্য হল বিশেষ ধরনের ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য। একাব্য রচনার মূল কারণ
স্বপ্নে দেব/দেবী কর্তৃক আদেশ লাভ। মঙ্গলকাব্যধারার মূল উপজীব্য দেব-দেবীর গুণগান।
এ কাব্যধারার কয়েকজন বিখ্যাত কবি- কানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত,
বিপ্রদাস পিপলাই, মাধব আচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্রীশ্যাম
পণ্ডিত, ভরতচন্দ্র রায়গুনাকর, ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ মাধব, ময়ূর ভট্ট, খেলারাম,
সীতারাম দাস, দ্বিজ বংশী দাস প্রমূখ।
বিভিন্ন দেবদেবীর গুণগান
মঙ্গলকাব্যর মূল বিষয়; তন্মধ্যে স্ত্রী দেবীদের প্রধান্যই বেশী এবং মনসা ও চণ্ডীই
এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গলকাব্য প্রধানত দুই প্রকার। যথা-
ó পৌরাণিক মঙ্গল কাব্য – অন্নদামঙ্গল, কমলামঙ্গল, দূর্গামঙ্গল প্রভৃতি
ó লৌকিক মঙ্গল কাব্য – মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, কালিমঙ্গল, গৌরীমঙ্গল (বিদ্যাসুন্দরী),
সারদামঙ্গল প্রভৃতি
উল্লেখ্য মঙ্গল শব্দটি থাকলেও ‘চৈতন্যমঙ্গল’, ‘গোবিন্দমঙ্গল’
প্রভৃতি বৈষ্ণব সাহিত্যের অংশ, মঙ্গলকাব্য নয়।
মনসামঙ্গল
মঙ্গলকাব্য ধারার
সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম ধারা মনসামঙ্গল। এর অপর নাম পদ্মপুরাণ। এটি
মূলত একটি আখ্যানকাব্য। সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় মনসামঙ্গল কাহিনী হল চাঁদ সাওদাগরের
বিদ্রোহ ও বেহুলার সতীত্ব কাহিনী। কাব্যের প্রধান আখ্যানটি আবর্তিত হয়েছে ইহলোকে
দেবী মনসার নিজ পূজা প্রচারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে। মনসামঙ্গলের উল্লেখযোগ্য
চরিত্র- মনসাদেবী, চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, লক্ষ্মীন্দর।
- মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কানাহরি দত্ত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ
কবি বিজয়গুপ্ত।
- মনসামঙ্গল কাব্য রচিত হয় সুলতান হুসেন শাহের শাসনামলে।
- মনসামঙ্গলের অন্যতম কবি নারায়ন দেবের জন্মস্থান বর্তমান
কিশোরগঞ্জ; তাঁর কাব্যের নাম ‘পদ্মাপুরাণ’, ‘সুকন্নানি‘।
- মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্তের জন্ম স্থান
বরিশাল জেলার বর্তমান গৈলা গ্রামে (প্রাচীন নাম ফুলশ্রী)। বিজয়গুপ্ত ‘পদ্মাপুরাণ’ নামক মনসামঙ্গল কাব্য রচনা
করেন।
- ‘মনসা বিজয়’ কাব্যগ্রন্থের রচিয়তা বিপ্রদাস পিপলাই। এটি ১৪৯৫ সালে প্রকাশিত হয়।
- মনসামঙ্গলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ক্ষেমানন্দের উপাধি
ছিল কেতকা দাস।
- দ্বিজ বংশীদাস: মনসামঙ্গলের সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি ছিল।
দ্বিজ বংশীদাস জন্মগ্রহণ করেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাতুয়ারী গ্রামে।
চণ্ডীমঙ্গল
মঙ্গলকাব্য ধারার শ্রেষ্ঠ
কাব্য চণ্ডীমঙ্গল। এ ধারার আদিকবি মানিক দত্ত। ষোড়শ শতকে এ
কাব্য ধারার সর্বাধিক প্রসার ঘটে। কাব্যটির রচনাকাল ষোড়শ থেকে আঠার শতক পর্যন্ত
বিস্তৃত। চণ্ডীমঙ্গল কাব্য ধারার শ্রেষ্ঠ কবি “কবিকঙ্কন” মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। কবি
মুকুন্দরাম জন্মগ্রহণ করেন বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে। তিনি মেদিনীপুর জেলার
অড়বা গ্রামের জমিদার রঘুনাথের সভাসদ ছিলেন। জমিদার রঘুনাথ মুকুন্দরামকে ‘শ্রী
শ্রী চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্য রচনার জন্য ‘কবিকঙ্কন’ উপাধি প্রদান করেন। মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অন্যান্য
নাম অভয়ামঙ্গল, অধিকামঙ্গল, গৌরিমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল প্রভৃতি।
এ কাব্যধারার উল্লেখ্যযোগ্য
কবি- দ্বিজমাধব (স্বভাব কবি), দ্বিজ রামদেব, মুক্তারাম সেন, হরিরাম, ভবানীশঙ্কর দাস, অকিঞ্চন চক্রবর্তী প্রমুখ।
আরও দেখুন – চণ্ডীমঙ্গল
(সংক্ষিপ্ত কাহিনী)
ধর্মমঙ্গল
ধর্মমঙ্গলের উপাস্য দেবতা
ধর্ম ঠাকুর বা ধর্ম দেবতা। কাব্যের প্রধান কাহিনী দুটি। যথা: (ক) রাজা
হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী এবং (খ) লাউসেনের কাহিনী। ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি ময়ূর ভট্ট। তার কাব্যগ্রন্থের নাম ‘হাকন্দপুরান’ (বা
‘শ্রীধর্মপুরাণ’)। ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী এবং তার
গ্রন্থের নাম ‘অনাদিমঙ্গল’। এছাড়া শ্যাম পণ্ডিত ধর্মমঙ্গলের অন্যতম কবি ছিলেন। তার
কাব্যগ্রন্থ ‘নিরঞ্জন মঙ্গল‘।
সংক্ষিপ্ত কাহিনী: ধর্মমঙ্গল
কালিকামঙ্গল
এর মূল উপজীব্য দেবী কালির
গুণ বর্ণনা। এ ধারার উল্লেখযোগ্য কবি সবিরিদ খান ও রামপ্রসাদ সেন। ‘কবিরঞ্জন’ রামপ্রসাদ সেনের উপাধি। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে এ উপাধি প্রদান করেন।
শিবমঙ্গল
দেবতা শিবের গুণ বর্ণনা এ
কাব্যের উপজীব্য। এ ধারার প্রথম কবি রামকৃষ্ণ রায়।
দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’, রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবকীর্তন’ এ ধারার
উল্লেখযোগ্য কাব্য।
অন্নদামঙ্গল
এ ধারার প্রধান কবি ভারতচন্দ্র রায়। তিনি মঙ্গলযুগের সর্বশেষ কবি। তাকে বাংলা
সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি বলা হয়। ভারতচন্দ্রের উপাধি ছিল রায়গুণাকর। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে এ উপাধি দেন।
অন্নদামঙ্গল কাব্য ৩ খণ্ডে বিভক্ত। এ কাব্যের প্রধান চরিত্র – বিদ্যাসুন্দর, হীরামালিনী, ঈশ্বরী পটানী।
বিখ্যাত উক্তি-
ó আমার সন্তান যেন
থাকে দুধে ভাতে
ó নগর পুড়িলে দেবালয়
কি এড়ায়
ó মন্ত্রের সাধন কিংবা
শরীর পাতন
ó বড়র পিরীতি বালির
বাধ! ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেক চাঁদ
এক নজরে-
ধারা |
আদিকবি |
সর্বশ্রেষ্ঠ কবি |
মনসামঙ্গল |
কানাহারি দত্ত |
বিজয়গুপ্ত |
চণ্ডীমঙ্গল |
মানিক দত্ত |
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী |
ধর্মমঙ্গল |
ময়ূর ভট্ট |
ঘনরাম চক্রবর্তী |
নাথ সাহিত্য
বৌদ্ধ ধর্মমতের সাথে
শৈবধর্ম মিশে নাথধর্মের উদ্ভব। নাথ সাহিত্য একশ্রেণীর ধর্ম প্রচারকারী সাহিত্য।
এটি শিব উপাসকদের নাথ ধর্মের কাহিনি অবলম্বনে রচিত। নাথ অর্থ ‘প্রভু’। নাথ ধর্ম মতালম্বীরা তাঁদের নামের শেষে ‘নাথ’ পদবী ব্যবহার
করতেন। নাথ সাহিত্য ২ প্রকার। যথা:
- মীননাথ ও তার শিষ্য গোরক্ষনাথের কাহিনি এবং
- রাজা গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস
অধঃপতিত গুরু মীননাথকে
গোরক্ষনাথ কর্তৃক উদ্ধারের বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে গোরক্ষনাথে কাহিনীতে।
গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসের সাহিত্যকর্মগুলোতে বর্ণিত হয়েছে আসন্ন অকাল মৃত্যুর হাত
থেকে বাঁচার জন্যে নাথগুরু জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে
গোপীচন্দ্রের সন্যাসীর বেশে গৃহত্যাগ এবং সময় উত্তীর্ণ হয়ে পুনরায় দেশে ফিরে
সুখে শান্তিতে রাজ্য পরিচালনার কাহিনী।
নাথ সাহিত্যের কবি-
কবি |
রচনা |
শেখ
ফয়জুল্লাহ (নাথ সাহিত্যের আদি কবি) |
গোরক্ষ
বিজয় |
শুকুর
মুহাম্মাদ |
গোঁপীচাঁদের
সন্ন্যাস |
ভীমসেন,
শ্যামদাস সেন, ভবানীদাস প্রমূখ |
মর্সিয়া সাহিত্য
মর্সিয়া আরবি শব্দ যার অর্থ
শোক প্রকাশ করা। বিষাদময় কাহিনি তথা শোকবহ ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে মর্সিয়া
সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছে। মর্সিয়া সাহিত্যগুলো এক ধরনের শোক কাব্য।
কবি |
রচনা |
তথ্য |
শেখ
ফয়জুল্লাহ |
জয়নবের
চৌতিশা |
মর্সিয়া
সাহিত্যের প্রথম কবি শেখ ফয়জুল্লাহ। |
দৌলত
উজির বাহরাম খান |
জঙ্গনামা |
কারবালার
বিষাদময় যুদ্ধ ‘জঙ্গনামা’-র বিষয়বস্তু। |
ফকির
গরীবুল্লাহ |
আমির
হামজা, সোনাভান |
উল্লেখ্য
ফকির গরীবুল্লাহর রচনা কোনগুলো তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। |
মুহাম্মদ
খান |
মক্তুল
হোসেন |
|
রাধারমণ
গোপ |
ইমামগনের
কেচ্ছা, আফতনামা |
রাধারমণ
গোপ হিন্দু কবি হয়েও মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করেছেন। |
হায়াত
মামুদ, মীর মোশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ প্রমূখ |
লোকসাহিত্য
লোকসাহিত্য হল মানুষের মুখে
মুখে প্রচলিত কাহিনী, ছড়া, গান, কথা, গীতিকা, ধাঁধাঁ, গাঁথা প্রভৃতির সমষ্টি। একে
বাংলা সাহিত্যের শিকড়সন্ধানী সাহিত্যও বলা হয়। সাধারণত কোন লোকালয়ের লোকমুখে
প্রচলিত অলিখিত সাহিত্যই লোকসাহিত্য। বাংলার অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী এ সাহিত্যে অবদান
রেখেছে। এদের একটি বড় অংশ হল লোক-কবি বা বায়তি। যেমন- মনসুর বায়তির একটি
পালাগান হচ্ছে ‘দেওয়ানা মদিনা’। এছাড়া ‘হারামনি’ একটি উল্লেখযোগ্য লোকসাহিত্য। এর
সংকলক মুহম্মদ মনসুউদ্দীন।
লোকসাহিত্যের আদিরূপ হচ্ছে
ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন ও ধাঁধা। এর প্রাচীনতম নিদর্শন ছড়া। ডাক ও খনার বচনকে
লোকসাহিত্যের আদি নিদর্শন বলা হয়। ডাক ও খনার বচনগুলো প্রাচীন যুগে সৃষ্টি হয়,
তবে মধ্যযুগে সমৃদ্ধি লাভ করে। বৌদ্ধ সমাজে ডাক-এর বচনের উৎপত্তি হয়েছিল আর খনার
বচন সৃষ্টি হয়েছিল হিন্দু সমাজে। মূলত কৃষক ও কৃষাণীরা এগুলো মুখস্ত রাখত। ডাকের
বচন ‘ডাকের কথা’ বা ‘ডাক পুরুষের কথা’ নামেও পরিচিত। খনার বচনগুলো কৃষিভিত্তিক।
এগুলো থেকে কৃষি, আবহাওয়া ও সমাজের পরিচয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। খনার
বচনের মূলভাব হচ্ছে শুদ্ধ জীবনযাপন রীতি।
উদাহরণ:
- ঘরে আখা বাইরে রাঁধে, অল্প কেশ ফুলাইয়া বাঁধে
(ডাক)
- গাছে গাছে আগুন জলে, বৃষ্টি হবে খনায় বলে (খনা)
সংগ্রহ
চন্দ্রকুমার দে বাংলা
লোকসাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য সংগ্রাহক। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ও স্যার
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বাংলার লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেন। তার
সংগৃহীত সাহিত্যগুলো ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও
‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে প্রকাশিত হয়। এছাড়া বাংলা লোকসাহিত্য নিয়ে রেভারেন্ড
লাল বিহারী ‘Folk Tales of Bengali (১৮৮৩)’, ড. সুনীল কুমার দে ‘প্রবাদ সংগ্রহ’ ও
ড. মযহারুল ইসলাম ‘কবি পাগলা কানাই’ নামক গ্রন্থ রচনা করে লোকসাহিত্য সংরক্ষণে
ভূমিকা রেখেছেন।
লোকগীতিকা
লোকগীতিকায় আবৃতির পাশাপাশি
লৌকিক প্রকাশভঙ্গির গীত হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নাটকীয়তা ও সংলাপধর্মিতা।
বাংলাদেশে সংগৃহীত গীতিকাগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: নাথ গীতিকা, মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা।
নাথ গীতিকা
নাথ গীতিকাগুলো একটিমাত্র
ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত। রাজা গোপীচাঁদ বা গোবিন্দ চন্দ্র মায়ের
নির্দেশে যৌবনে দুই নব পরিণীকা বধূকে রেখে সন্ন্যাস অবলম্বন করেন। এই কাহিনীকে
ঘিরেই রচিত নাথগীতিকা ‘গোপীচাঁদের সন্ন্যাস’। শুকুর মুহম্মাদ এর রচয়িতা। এছাড়া
ভবানীদাস রচিত ‘ময়নামতির গান’ একটি নাথ গীতিকা।
মৈমনসিংহ গীতিকা
বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার
মানুষের মুখে মুখে যে গীতিকাগুলো প্রচলিত ছিল তার সংকলনই হল ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’।
এতে মোট ১০টি গীতিকা রয়েছে। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় এটি ১৯২৩ সালে
প্রকাশিত হয়। এটি ২৩টি ভাষায় মুদ্রিত হয়েছে। গীতিকাগুলো নিম্নরূপ-
মৈমনসিংহ গীতিকার নাম |
রচয়িতা |
মহুয়া
(চরিত্র: নদের চাঁদ, মহুয়া) |
দ্বিজ
কানাই |
মলুয়া |
চন্দ্রাবতী |
কমলা |
দ্বিজ
ঈশান |
দেওয়ানা
মদিনা (চরিত্র: আলাল, দুলাল, মদিনা) |
মনসুর
বয়াতি |
চন্দ্রাবতী |
নয়ানচাঁদ
ঘোষ |
কঙ্ক
ও লীলা |
দমোদর,
রঘুসুত ও নয়াচাঁদ |
কাজলরেখা |
অজ্ঞাত |
পূর্ববঙ্গ গীতিকা
ড. দীনেশচন্দ্র সেন
নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে এগুলো সংগ্রহ করেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
অর্থানুকুল্যে তিনি ১৯২৬ সালে ৩ খন্ডে ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ প্রকাশ করেন। এতে ৫০টির
অধিক পালাগান রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু পূর্ববঙ্গ গীতিকা হল- নিজাম ডাকাতের পালা, কাফন চোর, কমল সদাগর, চৌধুরি লড়াই, কাঞ্চন মালা, আয়না বিবি, ভেলুয়া, কমলা রাণীর গান ইত্যাদি।
টপ্পাগান: কলকাতা অঞ্চলের একটি
লৌকিক গান। বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবেও পরিচিত। রামনিধি গুপ্ত (নিধু বাবু)
বাংলা টপ্পাগানের উদ্ভাবক।
লোককথা বা লোক কাহিনী
কোন কাহিনী গদ্যের মাধ্যমে
বর্ণিত হলে তাকে লোককথা বা লোককাহিনী বলে। এই কাহিনীগুলো কাব্যে রূপায়িত হলে
‘গীতিকা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। অর্থ্যাৎ মানুষের মুখে প্রচলিত কাহিনী গদ্যে
বর্ণিত হলে ‘কথা’ এবং কাব্যে বর্ণিত হলে ‘গীতিকা’। ড. আশুতোষ মুখপাধ্যায়ের মতে
লোককথা ৩ প্রকার। যথা: রূপকথা, উপকথা ও ব্রতকথা।
রূপকথা: অবাস্তব ও
অবিশ্বাস্য কাহিনী নিয়ে রচিত সাহিত্য হচ্ছে রূপকথা। বাংলা সাহিত্যে কিছু জনপ্রিয়
রূপকথা হল – দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ‘ঠাকুমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’, ‘কিশোরের
মন’, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরির ‘টোনাটুনির বই’।
উপকথা: পশুপাখি
মানবচরিত্রের মত কথা বলে এমন ভাবে সাহিত্যের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। কৌতুক
সৃষ্টি এবং নীতি প্রচারই এগুলো সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
ব্রতকথা: বাংলাদেশের
বিভিন্ন অঞ্চলের মেয়েলি ব্রতের সাথে সম্পর্কিত কাহিনি অবলম্বনে ব্রতকথা নামে এক
ধরনের সাহিত্য বিকাশ ঘটেছে।
ড. দীনেশচন্দ্র সেন
দীনেশচন্দ্র সেন একজন
স্মরণীয় লোক-সাহিত্যবিশারদ। ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে এক
সম্ভ্রান্ত বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা জেলার সুয়াপুর গ্রামে তার
পৈত্রিক নিবাস। তিনি ১৮৯০-এ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের
দায়িত্ব পালনকালে গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ
করেন। সেসব উপকরণের সাহায্যে ১৮৯৬-এ “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” শিরোনামে বাংলা সাহিত্যের
ইতিহাসগ্রন্থ রচনা করেন। ১৯১১ সালে তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ “হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি
লিটেরেচার” প্রকাশিত হয়। তিনি মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সম্পাদনা করেন।
এক নজরে লোকসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি
ó লোকসাহিত্য হল –
লোকের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনী, গান, ছড়া ইত্যাদি
ó বাংলার লোক সাহিত্যগুলোর
একজন সংগ্রাহক হলেন – চন্দ্রকুমার দে। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ও স্যার আশুতোষ
মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বাংলার লোকসাহিত্য সংগ্রহ করে।
ó ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’
ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ এর সম্পাদনা করেন – ড. দীনেশচন্দ্র সেন
ó নাথ গীতিকা – একটিমাত্র
ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত হয়।
ó লোকমুখে প্রচলিত
কাহিনী গদ্যের মাধ্যমে বর্ণিত হলে – লোক কথা বা কাহিনী
ó লোকমুখে প্রচলিত
কাহিনী কাব্যে মাধ্যমে বর্ণিত হলে – গীতিকা
ó অবাস্তব ও অবিশ্বাস্য
কাহিনী নিয়ে রচিত সাহিত্য – রূপকথা
অনুবাদ সাহিত্য
মধ্যযুগের অনুবাদ
সাহিত্যগুলো মূলত ভাবানুবাদ। এযুগের কবিরা পয়ার ছন্দে ভাবানুবাদগুলো রচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য অনুবাদ সাহিত্যগুলো হল –
রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদি।
মহাভারত
মহাভারত কথাটির অর্থ হল ভরত বংশের মহান উপাখ্যান। প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস সংস্কৃত ভাষায়
মহাভারত রচনা করেন। বেদ বাক্য ব্যাখ্যা করার জন্য তার নাম ‘বেদব্যাস’। তিনি
হিমালয়ের এক পবিত্র গুহায় তপস্যার পর মহাভারতের কাহিনী স্মরণ করেন এবং গণেশ সেই
কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। মোট ১৮টি খণ্ড ও ৮৫০০০ শ্লোক রয়েছে মহাভারত মহাকাব্যে। এতে
পাণ্ডব বংশের পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে কুরু বংশের ১০০ ভাইয়ের যুদ্ধের কাহিনী বিদ্ধৃত
হয়েছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে কবি
কবীন্দ্র পরমেশ্বর প্রথম মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি তার কাব্যের নাম
দিয়েছিলেন বিজয়পান্ডবকথা বা ভারত পাঁচালী। তিনি পরাগল খানের (নবাব হোসেন শাহের সেনাপতি)
পৃষ্ঠপোষকতায় এটি অনুবাদ করেন বলে তার অনুদিত মহাভারত গন্থকে ‘পরাগালী মহাভারত‘ও
বলা হয়। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশিরাম দাস।
রামায়ণ
বাল্মীকি সংস্কৃত ভাষায়
রামায়ণ রচনা করেন। এটি ৭টি কাণ্ড বা খণ্ডে বিভক্ত ও ২৪০০০ শ্লোকে রচিত মহাকাব্য।
শ্লোকগুলো ৩২ অক্ষরযুক্ত ‘অনুষ্টুপ’ ছন্দে রচিত। এ কাব্যের মূল উপজীব্য বিষ্ণুর
অবতার রামের জীবনকাহিনী।
রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকির
মূল নাম দস্যু রত্নাকর। তিনি এই নামে দস্যুবৃত্তি করতেন। বাল্মীক শব্দের অর্থ উইপোকা। দস্যু রত্নাকর উইপোকার ডিবির ওপর বসে তপস্যা করতেন বলে
তিনি বাল্মীকি নামে পরিচিত।
রামায়ণের প্রথম বাংলা
অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা। তার রচিত রামায়ণের নাম শ্রীরাম
পাঁচালী।
ভগবত
এটি একটি ভক্তিবাদী
ধর্মগ্রন্থ। মালাধর বসু একে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামে অনুবাদ করেন।
পুঁথি সাহিত্য
পুঁথি সাহিত্য বলতে ইসলামী
চেতনা সম্পৃক্ত সাহিত্যকে বোঝায়। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত আরবি, উর্দু, ফারসি
ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক শ্রেণির বাংলা সাহিত্যের নাম পুঁথি। এ সাহিত্যের
অধিকাংশ রচয়িতা এবং পাঠক উভয়েই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। একসময় বাংলায় সন্ধ্যা
নামলেই বসত পুঁথি পাঠের আসর। মধ্যযুগের ধর্মভিত্তিক সাহিত্যধারা থেকে মুসলিম
কবিরাই প্রথম পুঁথি সাহিত্যের মাধ্যমে সাহিত্যকে নিয়ে আসেন মানুষের কাছে। তারা
তুলে ধরেন মানুষের প্রেম, দুঃসাহসিক অভিযান, অনুভূতির অনাবিল উচ্ছ্বাস।
দোভাষী পুঁথি রচয়িতাদের
শায়ের বলা হত। ‘শায়ের’ আরবি শব্দ যার অর্থ কবি। মূলত মুসলমান সমাজের শায়েরগণ
‘দোভাষী পুঁথি’ রচনা করতেন। শায়েরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ফকির গরীবুল্লাহ,
সৈয়দ হামজা, মোহাম্মদ দানেশ, মালে মুহম্মদ, আব্দুর রহিম, আয়েজুদ্দিন, জনাব আলী,
মনিরুদ্দিন, মুহম্মদ খাতের, মুহম্মদ মুনশী প্রমুখ। পুঁথি সাহিত্যের প্রাচীনতম কবি
সৈয়দ হামজা এবং প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি ফকির গরীবুল্লাহ।
কবিওয়ালা ও
কবিগান
শায়েরদের সময়েই হিন্দু
সমাজে কবিওয়ালা বা সরকারদের আবির্ভাব ঘটে। কবিওয়ালারা ‘কবিগান’ রচনা করতেন।
কবিগানের আদিগুরু গোঁজলা গুই।
কবিগান এক ধরনের
প্রতিযোগিতামূলক গান। দুটি দলের মধ্যে এ প্রতিযোগিতা হয়। কবিগানের আসরে একজন
প্রধান গায়ক এবং কয়েকজন সহকারী থাকত। প্রধান গায়ককে ‘কবিয়াল বা সরকার’ এবং
সহকারীদের বলা হতো ‘দোহার’। সহকারীরা সাধারণত প্রধান গায়কের কথাগুলি পুণরাবৃত্তি
করতো। ১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সর্বপ্রথম কবিগান সংগ্রহ করেন এবং ‘সংবাদ
প্রভাকর’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
কবিওয়ালাদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য- গোঁজলা গুই, রাসু-নৃসিংহ, হরু ঠাকুর, নিলু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী, রাম
বসু, এন্টনি ফিরিঙ্গি, নিধুবাবু, দাশরথি রায় প্রমুখ। চারণকবি মুকুন্দ দাস
প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন কবিয়াল। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল চট্টগ্রামের রমেশ
শীল। তিনি মাইজভান্ডারী গানের কিংবদন্তি গায়ক ছিলেন।
রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান
মুসলমান কবিগণ বাংলা
সাহিত্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনায়।
মুসলমান কবিদের রচনাতেই প্রথম মানুষ প্রাধান্য পায়। চর্তুদশ শতকের শেষে ও পঞ্চদশ
শতকের শুরুতে শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত “ইউসুফ-জোলেখা” কাব্যের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে
রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনার সূচনা হয়।
ইউসুফ জুলেখা
বাংলা সাহিত্যের প্রথম
মুসলিম কবি ও রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারার প্রথম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর। তিনি
ফারসি কবি ফেরদৌসির “শাহনামা” কাব্য অবলম্বনে “ইউসুফ-জোলেখা” কাব্য রচনা করেন। এ
কাব্যের পটভূমি ইরান। উল্লেখ্য আব্দুর হাকিম,
ফকির গরিবুল্লাহ, ফকির মুহম্মদ প্রমূখ পৃথকভাবে “ইউসুফ-জোলেখা” কাব্য রচনা করেছেন।
লাইলী-মজনু
এটি ফারসি কবি জামির
“লায়লা ওয়া মাজনুন” কাব্যের ভাবানুবাদ। রচনা করেন দৈলত উজির বাহরাম খান।
এক নজরে উল্লেখযোগ্য অনুবাদ সাহিত্য ও রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান
গ্রন্থ |
অনুবাদক |
তথ্য |
মহাভারত |
কবীন্দ্র
পরমেশ্বর, কাশীরাম দাস, শ্রীকর নন্দী প্রমূখ |
মূল
গ্রন্থের রচয়িতা বেদব্যাস। |
রামায়ণ |
কৃত্তিবাস
ওঝা, চন্দ্রাবতী, দ্বিজ ভবানী দাস প্রমূখ |
মূল
গ্রন্থের রচয়িতা বাল্মীকি। |
শ্রীকৃষ্ণবিজয় |
মালাধর
বসু |
মূল
গ্রন্থের নাম ভগবত, রচয়িতা বেদব্যাস। |
ইউসুফ জুলেখা |
শাহ
মুহাম্মদ সগীর, আব্দুল হাকিম, ফকির গরীবুল্লাহ প্রমূখ |
|
লাইলী মজনু |
দৌলত
উজির বাহরাম খান |
|
জঙ্গনামা |
ফকির
গরীবুল্লাহ |
|
হপ্তপয়কর |
আলাওল |
|
সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী |
দৌলত
কাজী |
আরকান রাজসভা
সপ্তদশ শতকে বাংলা
সাহিত্যের ব্যাপক প্রসারে আরকান বিশেষ অবদান রাখে। বার্মার অন্তর্ভুক্ত “মগের
মুল্লুক” -এ আরকানের বৌদ্ধ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশ
সাধিত হয়। বাংলা সাহিত্যে আরকানকে “রোসাঙ্গ” বলা হয়। আরাকান রাজসভার আদি কবি ও
প্রথম বাঙালি কবি দৌলত কাজী। তিনি লৌকিক কাহিনীর প্রথম রচয়িতা। আরাকান রাজসভার
শ্রেষ্ট কবি আলাওল। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক- দৌলত কাজী, আলাওল, কোরেশী মাগন ঠাকুর, মরদন, আব্দুল করিম খোন্দকর।
সাহিত্যিক |
রচনা |
দৌলত কাজী |
সতীময়না
ও লোরচন্দ্রানী |
আলাওল |
পদ্মাবতী,
হপ্তপয়কর, সিকান্দারনামা, তোহফা, সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামান |
কোরেশী মাগন ঠাকুর |
চন্দ্রাবতী |
মরদন |
নসীরানামা |
আব্দুল করিম খোন্দকর |
দুল্লা
মজলিস, নূরনামা |
একনজরে বিভিন্ন সাহিত্যধারার উল্লেখযোগ্য কবি/লেখক
ধারা |
কবি/লেখক |
বৈষ্ণব
পদাবলি |
বিদ্যাপতি,
চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস, জয়দেব (সংস্কৃত) প্রমূখ। |
জীবনী
সাহিত্য |
শ্রীচৈতন্যদেবের
জীবনী: মুরারিগুপ্ত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, বৃন্দাবন দাস,
লোচন দাস প্রমূখ। |
মঙ্গলকাব্য |
মানসামঙ্গল: কানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস
পিপলাই, ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ বংশীদাস প্রমূখ। |
নাথ
সাহিত্য |
শেখ
ফয়জুল্লাহ, শুকুর মুহাম্মাদ, ভীমসেন, শ্যামদাস সেন, ভবানীদাস প্রমূখ। |
মর্সিয়া
সাহিত্য |
শেখ
ফয়জুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খান, গরীবুল্লাহ, মুহাম্মাদ খান, হায়াত মামুদ, মীর
মোশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, রাধারমণ গোপ প্রমূখ। |
লোকসাহিত্য |
নাথ
গীতিকা: শুকুর মুহাম্মদ, ভবানীদাস প্রমূখ। |
অনুবাদ
সাহিত্য |
কবীন্দ্র
পরমেশ্বর, কাশিরাম দাস, কৃত্তিবাস ওঝা, মালাধর বসু প্রমুখ। |
রোমান্টিক
প্রণয়োপাখ্যান |
শাহ
মুহম্মদ সগীর, আব্দুল হাকিম, ফকির গরীবুল্লাহ, দৌলত উজির বাহরাম খান, দৌলত কাজী প্রমূখ। |
বাংলা
সাহিত্যের অন্ধকার যুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রিঃ)
বাংলা
সাহিত্যের ১২০০-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে “অন্ধকার যুগ” বা “বন্ধ্যা যুগ” বলে কেউ
কেউ মনে করেন। অনুমান করা হয়, তুর্কি বিজয়ের ফলে মুসলিম শাসনামলের সূচনার পটভূমিতে
নানা অস্থিরতার কারণে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। ড. হুমায়ুন আজাদ
তাঁর “লাল নীল দীপাবলী” গ্রন্থে (পৃ. ১৭) লিখেছেন-
“১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত কোন সাহিত্য কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়না
বলে এ-সময়টাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এ-সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, অনেক
আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি। এ- সময়টির দিকে তাকালে
তাই চোখে কোন আলো আসেনা, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।”
কিন্তু, ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ (পৃ. ১০৫)-এ লিখেছেন-
“বাংলা সাতিহ্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম
-শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা
সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ
করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।”
বর্তমানে অনেক গবেষকই এ সময়কে অন্ধকার যুগ বলতে নারাজ। কেননা তাঁরা ঐতিহাসিক ভাবে
বিভিন্ন প্রমান সহ বলতেছেন যে, সংখ্যায় কম হলেও এ সময়েও সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, আর
এ সংখ্যা কমের জন্য কোনভাবেই মুসলিম/তুর্কি শাসন দায়ী নয়।
এসময়ের সাহিত্য নিদর্শন:
১. প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’
২. রামাই পন্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত)
৩. হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেক শুভোদয়া’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত)
৪. ডাক ও খনার বচন
‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ শূন্যপুরাণ এর অন্তর্গত একটি কবিতা।
তাই বলা যায় মধ্যযুগের অর্থাৎ ১২০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ত্রয়োদশ
শতকের শুরুর দিকে ‘সেক শুভোদয়া’ এবং শেষের দিকে ‘শূন্যপুরাণ’র অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকা
অবস্থায় এ সময়টাকে তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে
একটি ‘অপবাদ’ লেপনের অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা।)
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
কাব্য
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
বড়ুচণ্ডীদাস নামক জনৈক মধ্যযুগীয় কবি রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি
আখ্যানকাব্য। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা
গ্রাম থেকে এই কাব্যের একটি পুথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায়
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে পুথিটি প্রকাশিত হয়। যদিও
কারও কারও মতে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’।
কৃষ্ণের জন্ম,
বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে
কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মূল
উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট এগারোটি খণ্ডে বিভক্ত। পুথিটি খণ্ডিত বলে কাব্যরচনার তারিখ
জানা যায় না। তবে কাব্যটি আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে
রচিত বলে প্রাচীন বাংলা নাটকের একটি আভাস মেলে এই কাব্যে। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে
আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও
চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
চর্যাপদের পর
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা
ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত
কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব
পদাবলির পথ সুগম হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
যথার্থই লিখেছেন,
“ জয়দেব ও ভারতচন্দ্রকে বাদ দিলে এ ধরণের কাব্য সমগ্র পূর্বভারতেই আর পাওয়া যাবে
না।… বোধ হয় সেকালের শ্রোতারা এই পাঁচালি গানে বাস্তবতার সঙ্গে কিছু অধ্যাত্ম
ব্যঞ্জনাও লাভ করত। কিন্তু আধুনিক কালের পাঠক এ কাব্যের প্রত্যক্ষ আবরণ অধিকতর
আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করবেন। রাধাকৃষ্ণলীলায় কিছু উত্তাপ ছিল, জয়দেবের
গীতগোবিন্দে সেই উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, সে উত্তাপ ‘অভিনব
জয়দেব’ বিদ্যাপতির পদেও কিছু স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করেছে। ভারতচন্দ্র সেই উত্তাপকে
কামনার পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে নর-নারীর প্রণয়চর্চাকে আলোকিত করেছেন। দেহের এই
রহস্য চৈতন্য ও উত্তর-চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতে উত্তাপ হারিয়ে স্থির দীপশিখায়
পরিণত হয়েছে।
আবিষ্কার
ও প্রকাশনা
১৯০৯ সালে
বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড় গ্রামের বাসিন্দা বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ
প্রাচীন পুথির অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঐ জেলারই বিষ্ণুপুর শহরের নিকটবর্তী কাকিল্যা
গ্রামের জনৈক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে প্রথম শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
কাব্যের পুথি আবিষ্কার করেন। তাঁর গোয়ালঘরের মাচায় এই পুথিটি তুলে রাখা ছিল।
দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বনবিষ্ণুপুরের রাজগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের
দৌহিত্র বংশধর। পুথিটির সঙ্গে প্রাপ্ত চিরকূটটি থেকে জানা যায় যে আড়াই শত বছর
আগে বিষ্ণুপুরের ‘গাঁথাঘর’ অর্থাৎ রাজগ্রন্থশালায় এটি রাখা ছিল। আদ্যন্ত খণ্ডিত অবস্থায় প্রাপ্ত এই পুথিটি
তুলোট কাগজে লিখিত এবং এতে তিন প্রকার লিপি দেখা যায় – প্রাচীন লিপি, প্রাচীন
লিপির হুবহু অনুকরণ লিপি ও পরবর্তীকালের লিপি। পুথির প্রথম দুটি পাতা, মাঝের
কয়েকটি ও শেষ পাতাগুলি পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ২৪৩/১ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
রোডস্থ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুথিশালায় এটি রক্ষিত আছে। বসন্ত রঞ্জন রায়
বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দে) কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য
পরিষদ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শিরোনামে পুথিটি সম্পাদনা করেন এবং ঐ বছরেই উক্ত
প্রতিষ্ঠান সেটি প্রকাশ করেন।
নামকরণ
বিদ্বদ্বল্লভ
মহাশয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শিরোনামে গ্রন্থটি সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেও, এই গ্রন্থের
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। প্রাচীন পুথিগুলিতে সচরাচর
প্রথম বা শেষ পাতায় পুথির নাম লেখা থাকে। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পুথির
ক্ষেত্রে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি। ফলে পুথির নামও অজানাই থেকে
যায়। এমনকি পরবর্তীকালের কোনও পুথিতেও বড়ু চণ্ডীদাস বা তাঁর গ্রন্থের কোনও
উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় তাই নামকরণকালে পুথির কাহিনি বিচার
করে লোকঐতিহ্যের অনুসারে এটি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর
বক্তব্য ছিল,
“ পুথির আদ্যন্তহীন খণ্ডিতাংশে কবির দেশকালাদির কথা দূরে থাকুক, পুথির নাম পর্যন্ত
পাওয়া যায় নাই। কথিত হয়, চণ্ডীদাস কৃষ্ণকীর্তন কাব্য রচনা করেন। খেতরীর এক
বার্ষিক উৎসবে চণ্ডীদাসের কৃষ্ণলীলা গীত হইয়াছিল, অবশ্য কীর্তনাঙ্গে। আলোচ্য
পুথির প্রতিপাদ্য যে শ্রীকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, তাহাতে তর্কের অবসর নাই। অতএব
গ্রন্থের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামকরণ অসমীচীন নয়। ”
গ্রন্থপ্রকাশের
প্রায় ১১ বছর পর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় রমেশ বসু সম্ভবত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’
কাব্যের নামকরণকেন্দ্রিক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। এরপর বাংলা সাহিত্যের সারস্বত
সমাজে এ-নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক উপস্থিত হয়। যাঁরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের
বিরোধী ছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল দ্বিমুখী। প্রথমত, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ একটি
আদিরসাত্মক অশ্লীল কাব্য – এতে শ্রী বা কীর্তন কোনওটিই উপস্থিত নেই। দ্বিতীয়ত,
পুথির সঙ্গে যে চিরকূটটি পাওয়া যায়, তাতে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’ বলে একটি কথা
লিখিত আছে। অনেকে মনে করেন গ্রন্থের মূল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। প্রথম যুক্তিটি
আধুনিক কাব্যবিচারের দৃষ্টিতে খুবই দুর্বল; কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ দ্বিতীয় দাবিটি
প্রসঙ্গেও যথেষ্ট সন্দিহান। এই কারণে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন,
“ যতদিন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যথার্থ নাম আবিষ্কৃত না হচ্ছে ততদিন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন
রায় বিদ্বদ্বল্লভ প্রদত্ত এই নামটিই স্বীকার করতে হবে। ”
বড়ুচণ্ডীদাস
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’
কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু
পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি
ভণিতা পাওয়া যায় – ‘বড়ুচণ্ডীদাস’, ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘আনন্ত বড়ুচণ্ডীদাস’। এর মধ্যে
‘বড়ুচণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার। ৭টি
পদে ব্যবহৃত ‘আনন্ত’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়। ডঃ মিহির চৌধুরী
কামিল্যা মনে করেন, চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি
বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ। কবি চৈতন্যপূর্ববর্তীকালের মানুষ।
সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস
সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও বীরভূমের মধ্যে যত বিবাদই
বিদ্যমান থাকুক না কেন, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের
সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার
সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন। এই বাসলী
দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী কালীর অপর নাম।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” – এর বিষয়বস্তু
১. এ কাব্যে মোট ১৩টি খন্ড রয়েছে
২. এ কাব্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রাধা – কৃষ্ণ এর প্রেমলীলা
বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রেক্ষাপটঃ
এ কাব্যটি রচনার ৫০০ বছর পর আবিষ্কার করা হয়। বর্তমানে
কাব্যটির বয়স ৬০০ বছর। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় যার উপাধি বিদ্বদ্ববল্লভ। তিনি
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামে এক
গৃহস্থলীর গোয়াল ঘরের টিনের চালের নীচ থেকে আবিস্কার করেন। ১৯১৬ সালে কলকাতা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ যা পরে নাম পরিবর্তন করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য রাখা হয়।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” এর প্রধান চরিত্র
১. রাধা ২. কৃষ্ণ ৩ . বড়াই
১ . রাধা: এ কাব্যে রাধা কেন্দ্রীয় নারী তথা নায়িকা চরিত্রে
ঘোষ পরিবারে জন্ম। অপূর্ব সুন্দরী রাধার বিয়ে হয়
বীরপুরুষ আয়ান ঘোষ / আইহন ঘোষ এর সাথে। আয়ান
ঘোষের গৃহে রাধার দেখাশুনার দায়িত্বভার পরে
তার পিসিমা বড়াই এর উপর। পৌরাণিক কাহিনী
মতে রাধা মানবাত্নার প্রতীক। এ কাব্যে রাধা
রক্তমাংসে গড়া এক নারী যার মনে প্রেম আছে আবার
দৈহিক কামনা বাসনা চরিতার্থ করার আকাঙ্ক্ষাও
আছে।
২ . কৃষ্ণঃ এ কাব্যের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র। তার প্রধান গুণ বাঁশীবাদক /
বংশীবাদক। তার প্রধান পরিচয় রাধার প্রেমিক রূপে।
রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের প্রতিবেশী মামী ছিলেন। পৌরাণিক
কাহিনীমতে কৃষ্ণ হচ্ছে ভগবান /
স্রষ্টা / পরমাত্না। কিন্তু এ কাব্যে রক্তমাংসে গড়া এক যুবক।
৩ . বড়াইঃ বড়াই এ কাব্যের ৩য় চরিত্র। রাধা কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্ক
সৃষ্টিতে বড়াই এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এজন্য বড়াইকে
রাধা – কৃষ্ণের প্রেমের দূতী বলা হয়।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য” – একনজরে
১. বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের আদি নিদর্শন হল “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
কাব্য”
২. বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ পশ্চিমবঙ্গের
বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের এক গৃহস্থের
গোয়ালঘর থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য উদ্ধার
করেন।
৩. গ্রন্থটি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে বসন্তরঞ্জন
রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
৪. ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র রচয়িতা হলেন -বড়ু চণ্ডীদাস। এখানে মনে রাখতে
হবে,বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন
‘চর্যাপদ’ এবং দ্বিতীয় নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।’চর্যাপদে’র
রচয়িতা হলেন ২৪ জন কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত’ন
কাব্যের রচয়িতা হলেন ১ জন (বড়ু চণ্ডীদাস)।
তাই বলা যায়,বাংলা সাহিত্যের প্রথম একক কবির রচিত গ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।
৫.‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র আলোচ্য বিষয় হল রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা।
৬. এখানে রূপকের মাধ্যমে ‘রাধা’ বলতে সৃষ্টি/ভক্ত/জীবাত্মাকে এবং
‘কৃষ্ণ’ বলতে স্রষ্টা/ভগবান/পরমাত্মাকে বুঝানো হয়েছে। তার মানে
রাধা-কৃষ্ণের প্রমের মাধ্যমে বৈষ্ণবতত্ত্বের
এক গূঢ় রহস্য কথা ব্যক্ত হয়েছে।
যেখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মাধ্যমে জীবাত্মা- পরমাত্মার
প্রেমকে বুঝানো হয়েছে।
৭.আর এই প্রেমের দূতিয়ালি বা ঘটকালি করেছেন বড়াই।
৮. ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের প্রধান চরিত্র হল ৩টি (রাধা, কৃষ্ণ ও
বড়াই)।
৯. সর্বজন স্বীকৃত ও খাঁটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম গ্রন্থ
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’।
১০.মধ্যযুগের আদি কবি বড়ু চণ্ডীদাস।
১১.‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কাব্যের মূল নাম ছিল ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’।
১৯১৬ সালে প্রকাশের সময় বসন্তরঞ্জন রায়
এর নাম পরিবর্তন করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাখেন।
১২.‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে ১৩ টি খণ্ড ও ৪১৮ টি পদ আছে।
বৈষ্ণব পদাবলি
বৈষ্ণব পদাবলি বা বৈষ্ণব পদাবলী
বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য নামে খ্যাত এক শ্রেণীর ধর্মসঙ্গীত সংগ্রহ। বৈষ্ণব পদাবলী
সাহিত্যর সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস-এর সময়ে তবে ষোড়শ শতকে এই
সাহিত্যের বিকাশ হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা।
বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব
শ্রীকৃষ্ণ হলেন সৎ-চিৎ-আনন্দের মূর্তিমান বিগ্রহ।রাধা তাঁরই প্রকাশাত্মিকা শক্তি।শ্রীকৃষ্ণের
হ্লাদিনী অংশ সঞ্জাত রাধা সৃষ্টি হয়েছেন তাঁরই লীলাসুখানুভবের জন্য।শ্রীরাধা আয়ান
বধূ।তাই শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর প্রেম অসামাজিক, পরকীয়া।জীবও তেমনই তত্ত্বের দিক থেকে
শ্রীকৃষ্ণের স্বকীয় হলেও রূপ-রস-গন্ধযুক্ত জগতের সঙ্গে সে এমনই নিবিড়ভাবে আবদ্ধ যে
সে তার স্বকীয়তা ভুলে যায়।সেই ভুল ভাঙলে জীব ভগবানের ডাকে সাড়া দেয়, তখন ঘটে তার
পরকীয়া অভিসার।এভাবেই তৈরী হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব।
বৈষ্ণব পদাবলী বিভিন্ন পর্যায়
পূর্বরাগ
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর "উজ্জ্বলনীলমণি"তে শৃঙ্গারকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন।
ক)বিপ্রলম্ভ,খ) সম্ভোগ। আবার বিপ্রলম্ভকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- পূর্বরাগ,
মান, প্রেমবৈচিও, ও প্রবাস। শ্রীরূপ গোস্বামী পূর্বরাগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন---
রতির্যা সংগমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা।
তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈ পূর্বরাগ স উচ্যতে।।
প্রকৃত মিলনের আগে নায়ক নায়িকার পারস্পরিক দর্শন প্রভৃতি থেকে জাত মিলনেচ্ছাময় রতি
উপযুক্ত সঞ্চারীভাব ও অনুভাবের দ্বারা পুষ্ট হয়ে প্রকাশ পেলে তাকে পূর্বরাগ বলে।
পূর্বরাগ অবস্হার সঞ্চারীভাব হল ব্যাধি, শঙ্কা, অসূয়া, শ্রম, ক্লম বা ক্লান্তি, নির্বেদ,
ঔৎসুক্য, দৈন্য, চিন্তা, নিদ্রা, জাগরণ, বিষাদ, জড়তা, উন্মাদ, মোহ ও মৃত্যু।
কৃষ্ণবিষয়ক রতির সাধারণী, সমঞ্জসা ও সমর্থার বিভাগ অনুসারে পূর্বরাগের সাধারণ, সমঞ্জস
ও প্রৌঢ় এই তিনটি ভাগ।এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রৌঢ়-পূর্বরাগের প্রধান দশটি সঞ্চারীভাব---লালসা,
উদ্বেগ, জাগরণ, তানব, জড়িমা, বৈয়গ্র্য, ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ এবং মৃতির (মৃত্যু বাসনা)
মধ্য দিয়ে এই পূর্বরাগ "দশা" রূপ লাভ করে।
অনুরাগ
যে রাগ নিত্য নব রূপে সর্বদা অনুভূত প্রিয়জনকেও নতুনভাবে অনুভব করিয়ে প্রতি মুহূর্তেই
প্রেমকে নবীনতা দান করে তাকেই অনুরাগ বলে।
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর "উজ্জ্বল নীলমণি" গ্রন্থে অনুরাগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে
বলেছেন ---
সদানুভূতমপি যঃ কূর্যান্নবনবং প্রিয়ম্।
রাগো ভবন্নবনবঃ সোহগনুরাগ ইতীর্যতে।।
অনুরাগের ফলে প্রিয়স্বাদ বাসনার তৃপ্তি হয়না কখনো আর প্রীতিও পরিণতি পায়না। অনুরাগের
লক্ষণ চারটি। ক)পরস্পরবশীভাব, খ) প্রেমবৈচিত্ত, গ) অপ্রাণীতেও জন্মলাভের উৎকট লালসা,
ঘ) বিরহেও কৃষ্ণ অনুভব বা বিপ্রলম্ভে বিস্ফুর্তি।
অভিসার
অভিসার শব্দের অর্থ সংকেত স্থানে গমন। আগে উদ্দিষ্ট স্থানে যাওয়া বোঝাতে শব্দটি ব্যবহৃত
হত। ক্রমশ এটি প্রেমিক প্রেমিকার মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্পরের অভিমুখে যাত্রাকেই বোঝাতে
থাকে। "রসকল্পবল্লী"তে উদ্ধৃত অভিসারিকার সংজ্ঞা হল---" কান্তার্থিনী
তুখা যাতি সংকেতং অভিসারিকা।" কান্তের উদ্দেশ্যে যিনি সংকেত স্থানে গমন করেন,
তিনিই অভিসারিকা। নারায়ণদাস রচিত গীতগোবিন্দের " সর্বাঙ্গসুন্দরী" টীকায়
অভিসারিকার সংজ্ঞা হল--
দুর্বার দারুণ মনোভাববহ্নিতপ্তা
পর্য্যাকুলাকুলিত-মানসমাবহন্তি।
নিঃশঙ্কিনী ব্রজতি যা প্রিয়সঙ্গমার্থং
সানায়িকা খলু ভবেদভিসারিকেতি।।
দুর্বার দারুণ মদন-বহ্নিতে উওপ্তা, যে নায়িকা আকুল মনে নির্ভয়ে প্রিয়র সাথে মিলিত হওয়ার
জন্য যাত্রা করেন তিনিই অভিসারিকা।
শ্রীরূপ গোস্বামীর "উজ্জ্বল নীলমণি"তে অভিসারিকার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-----
যাভিসারয়তে কান্তং স্বয়ং বাভিসরত্যপি।
সা জ্যোৎস্নী তামসী যান যোগ্যবেশাভিসারিকা।।
লজ্জয়া স্বাঙ্গলীনের নিঃশব্দাখিলমন্ডনা।
কৃতাবগুন্ঠা স্নিগ্ধৈক সখিযুক্তা প্রিয়ং ব্রজেৎ।।
"রসকল্পবল্লী"তে অভিসারিকার সংকেত স্থান কি কি হতে পারে তারও উল্লেখ আছে।
নিকুঞ্জকানন, উদ্যান, জলশূন্য পরিখা, অট্টালিকার গবাক্ষ, নদী তীরের কন্টকযুক্ত বাঁধ,
গৃহের পিছন, ভাঙা মঠ মন্দিরকে অভিসারের সংকেত স্থান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
পীতাম্বর দাস "রসমঞ্জরী"তে আট ধরনের অভিসারের কথা বলেছেন।
সেই অভিসার হয় পুন আট প্রকার।
জ্যোৎস্নী, তামসী, বর্ষা, দিবা-অভিসার।।
কুজ্ঝটিকা, তীর্থযাত্রা, উন্মত্তা, সঞ্চরা।
গীত পদ্য রসশাস্ত্রে সর্ব্বজনোৎকরা।।
আসলে অভিসারের এই সময় বৈচিত্র্যই বুঝিয়ে দেয় অভিসারের কোনও দিন-ক্ষণ নেই। প্রাণের আবেগ
অসময়কেও সময় করে তোলে। বৈষ্ণব পদাবলীতেও শ্রেষ্ঠ অভিসার- বিষয়ক বেশিরভাগ পদই বর্ষণমুখর
রাতে রাধার তিমিরাভিসারের বর্ণনা।
অভিসার পর্যায়ের বিশেষত্ব হল প্রকৃতি এখানে রাধাকৃষ্ণের প্রেমে বা রাধাকৃষ্ণের মিলনের
পথে প্রতিকূল ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আর সেই প্রতিকূলতার কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েছে রাধার
'নিকষিতহেম' তুল্য কৃষ্ণপ্রেম। এই রাধা বিঘ্নবিজয়িনী, অধ্যাত্মপথযাত্রিণী।
প্রেম বৈচিত্ত্য
ও আক্ষেপানুরাগ
প্রিয়স্য সন্নিকর্ষোহনপি প্রেমোৎকর্ষস্বভাবতঃ।
যা বিশ্লেষধিয়ার্তিস্তৎ প্রেমবৈচিত্ত্যমুচ্যতে।।
প্রেমোৎকর্ষহেতু প্রিয়তমের নিকটে অবস্থান করেও বিচ্ছেদের ভয় থেকে যে আর্তি তাকে প্রেমবৈচিত্ত্য
বলে। বৈচিত্ত্য শব্দের অর্থ চিত্তের অন্যথা ভাব। গোপী প্রেমে বিশেষ করে মহাভাবময় রাধাপ্রেমে
এই ভৃবের প্রকাশ বিশেষভাবে হয়ে থাকে।
দীনবন্ধু দাস তাঁর " সংকীর্তনামৃতে" প্রেমবৈচিত্তের যে আটটি বিভাগ করেছেন
তা হল--- রূপানুরাগ, উল্লাস অনুরাগ, পাঁচ ধরনের আক্ষেপানুরাগ ও রসোদগার। পাঁচ ধরনের
আক্ষেপানুরাগ হল কৃষ্ণের প্রতি, মুরলীর প্রতি, নিজের প্রতি, সখীগণের প্রতি, ও দূতির
প্রতি আক্ষেপ।
আক্ষেপানুরাগে শ্রীমতি রাধার সর্বদা বিরহ অবস্থার প্রকাশ। প্রায় অকারণ বিরহ কাতরতা,
কৃষ্ণ মথুরায় না গেলেও স্বল্পকালীন বিচ্ছেদের অসহনীয় অবস্থায় আক্ষেপই এই পর্যায়ের পদের
বৈশিষ্ট। আক্ষেপানুরাগ প্রেমবৈচিত্ত্যেরই অংশ। প্রেমবৈচিত্ত্যে রাধাকৃষ্ণ ঘনিষ্ঠ মিলনের
মধ্যেও বিরহ কাতরতা অনুভব করেন। আর আক্ষেপানুরাগে স্থায়ী দুঃখকাতরতা লক্ষ করা যায়।
এই দুঃখ যেহেতু রাধার অনুভবের ব্যাপার তাই এর শেষও নেই। প্রকৃতপক্ষে আক্ষেপানুরাগের
মধ্যেই মহাভাবস্বরূপিণী রাধার সমাজ সংস্কার, নিজের অদৃষ্ট, কৃষ্ণের দেওয়া দুঃখ, এমনকি
নিজের কাছ থেকে পাওয়া দুঃখের পূর্ণ পরিচয় লাভ করা যায়।
মাথুর
' মাথুর' বিরহ পর্যায়ের একটি অবস্থা। পূর্বে মিলিত যুবক যুবতীর কেউ যদি দেশান্তরে গমন
করেন তখনই বিরহ সম্ভব হয়। এই অবস্থাকে বলে প্রবাস। 'উজ্জ্বল নীলমণি'তে শ্রীরূপ গোস্বামী
বলেছেন---
পূর্বসঙ্গতয়োর্যূনোর্ভবেদ্দেশান্তরাদিভিঃ।
ব্যবধানস্তু যৎপ্রাজ্ঞৈঃ স প্রবাস ইতির্যতে।।
প্রবাস-বিপ্রলম্ভ নিকট প্রবাস ও দূর প্রবাস ভেদে দুরকমের। কালিয়দমনে, গোচারণে নন্দমোক্ষণে,
কার্যানুরোধে, স্থানান্তরগমনে এবং রাসের অন্তর্ধানে--- এই পাঁচ প্রকার নিকট প্রবাস
হয়।
দূর প্রবাস তিন প্রকার।-- ভাবী, ভবন্ ও ভূত বা মথুরা প্রবাস।
ভাবী- বিরহে হঠাৎ বিরহ ঘনিয়ে আসছে বলে মনে হয়। যেমন একটি রথ এসেছে দেখে আশঙ্কা হয়,
কৃষ্ণ বুঝি ওই রথে চড়ে চলে যাবেন।
কৃষ্ণ চলে যাচ্ছেন এই অবস্থা হল ভবন বিরহ।
কৃষ্ণ আসবেন কথা দিয়ে চলে গেছেন কিন্তু নির্দিষ্ট দিন উত্তীর্ণ হওয়ার পরও তিনি এলেন
না। এই অবস্থা হল ভূত প্রবাস। এই অবস্থায় নায়িকার যে দশ দশা হয় শ্রীরূপ গোস্বামী তার
বিভিন্ন নাম দিয়েছেন--- চিন্তা, জাগরণ, উদ্বেগ, তানব বা কৃশতা, মলিনাঙ্গতা, প্রলাপ,
ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ ও মৃত্যু।
প্রবাসের আরও একরকম বিভাজন হয়।-- বুদ্ধি পূর্বক ও অবুদ্ধি পূর্বক।
বিদ্যাপতি:
বিদ্যাপতি পঞ্চদশ শতকের মৈথিল কবি | বঙ্গদেশে
তাঁর প্রচলিত পদাবলীর ভাষা ব্রজবুলি |কথিত আছে যে পরমপুরুষ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিত্য
তাঁর রচনা গাইতে ভালবাসতেন |অনেক বাঙালী কবি এই ভাষায় কবিতা রচণা করেছেন | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ভানুসিংহের পদাবলীতে' আমরা এই ভাষার ব্যবহার
দেখতে পাই |বাঙালীরা চর্যাগীতির ভাষা থেকে এই ব্রজবুলীকে অনেক সহজে বুঝতে পারেন | এই
কারণেই বিদ্যাপতিকে বাঙালী কবিদের অন্যতম হিসেবেই গণ্য করা হয় | তাঁর পদাবলী ছন্দ, আলংকারিক নৈপুণ্য ও গভীর হৃদয়াবেগে সমৃদ্ধ | প্রেম
ও ভক্তি তাঁর কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে |
কবি ও কাব্যপরিচয়
কবি বিদ্যাপতির জন্ম দ্বারভাঙা জেলার বিসফী গ্রামের এক বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার
কৌলিক উপাধি ঠক্কুর বা ঠাকুর। বংশপরম্পরায় তারা মিথিলার উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন। শস্ত্র,
শাস্ত্র, রাজ্যশাসন ও সংস্কৃতি সাহিত্যে তাদের দান বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। তিনি যে
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন ছয়জন রাজা ও একজন রানীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ থেকেই তার
স্বীকৃতি মেলে। কবি স্মৃতিকার রাজনীতিবিদ ব্যবহারবিদ ও আখ্যান লেখক হিসেবে তিনি সুপরিচিতি।
তার রচনাবলির মধ্যে রয়েছে কীর্তিলতা ভূপরিক্রমা, কীর্তিপতাকা, পুরুষ পরীক্ষা, শৈবসর্বস্বসার,
গঙ্গাবাক্যাবলি, বিভাগসার, দানবাক্যাবলি, লিখনাবলি, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী। তিনি প্রায়
আট শ’ পদ রচনা করেন। জীবৎকালে বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিতরূপে তার প্রতিষ্ঠা ছিল।
মিথিলার কবি হলেও অমর পদাবলি অচিরেই সমগ্র বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মিথিলার উপভাষা
ব্রজবুলিই তাঁর পদাবলির বাহন। এই ভাষার ধ্বনি-মাধুর্য ও সঙ্গীতময়তা বাংলা কাব্যকে,
বিশেষ করে বৈষ্ণব পদাবলিকে সমৃদ্ধ করেছে। বিষয়ের লালনে, ধ্বনি, শব্দ, অলঙ্কার প্রভৃতির
ব্যবহারে তার নাগরিক বৈদগ্ধ ও মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি চৈতন্য-পূর্ববর্তী
কবি। তাই তার রাধা মানবীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। রাধার বয়:সন্ধির দৈহিক সুষমা ও লাস্যময়তা
তার পদাবলিকে ঐশ্বর্যময় করেছে। ভাব-সম্মিলন ও ভাবোল্লাসের পদেও বিদ্যাপতি এক প্রকার
প্রতিদ্বন্দ্বিহীন। তার ভাব সম্মিলনের একটি পদ এখানে সঙ্কলিত হয়েছে।
কবি বিদ্যাপতি ‘মৈথিল কোকিল’ ও অভিনব জয়দেব নামেখ্যাত এই বিস্ময়কর প্রতিভাশালী কবি
একাধারে কবি, শিক্ষক, কাহিনীকার, ঐতিহাসিক, ভূবৃত্তান্ত লেখক ও নিবন্ধকার হিসেবে ধর্মকর্মের
ব্যবস্থাদাতা ও আইনের প্রামাণ্য গ্রন্থের লেখক ছিলেন।
ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, বিদ্যাপতি সম্ভবত ১৩৮০-১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত
ছিলেন। সংস্কৃতে তার পাণ্ডিত্য ছিল, অপভ্রংশে তিনি কীর্তিলতা নামে ঐতিহাসিক কাব্য লিখেছিলেন,
বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্টিবৈচিত্র্য তাকে বিশিষ্ট করেছে; কিন্তু নিজ মাতৃভাষা মৈথিলীতে
রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা বিষয়ক যে অত্যুৎকৃষ্ট পদাবলি রচনা করেছিলেন তা-ই তাকে অমরতা দান
করেছে। তার পদাবলি বাংলা আসাম উড়িষ্যা ও পূর্ববিহারে সমাদৃত। শ্রীচৈতন্যদেবের আগে
তার আবির্ভাব হয়েছিল বলে বৈষ্ণবের বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা চলে না; তবে
কবি হৃদয়ের নিবিড় আকুতি বৈষ্ণব পদাবলিতেই তিনি প্রতিফলিত করেছেন। রাজা শিবসিংহের
আমলে রচিত কবিতায় যে পরিমাণে ‘বিলাস কলাকৌতূহল, নর্মলীলার উল্লাস এবং আনন্দোজ্জ্বল
জীবনের প্রাচুর্য’ দেখা যায় তা পরবর্তীকালের রচনায় অনুপস্থিত।
কবি বিদ্যাপতির কাব্যে চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণবতত্ত্ব প্রতিফলিত হয়নি, তিনি এই অলৌকিক প্রেমকাহিনীকে
মানবিক প্রেমকাহিনী হিসেবে রূপ দিয়েছেন। নবোদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী রাধার বয়:সন্ধি থেকে
কৃষ্ণবিরহের সুতীব্র আর্তি বর্ণনা বিদ্যাপতির কবিতায় উপজীব্য। রাধা চরিত্রের পরিকল্পনায়
অপূর্ব কবিত্বের পরিচয় দিয়ে কবি কামকলায় অনভিক্ষা বালিকা রাধাকে শৃঙ্গার রসের পূর্ণাঙ্গ
নায়িকায় রূপান্তরিত করেছেন, প্রগাঢ় প্রেমানুভূতি দেহমনকে আচ্ছন্ন করে রাধার মনে
ভাবান্তর এনেছেন, কৃষ্ণবিরহের তন্ময়তায় রাধার বিশ্বভুবন বেদনার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছেন।
বিদ্যাপতির পদে শাশ্বত কালের কলাকুতূহপূর্ণা রহস্যময়ী নায়িকার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি
প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন, ‘এই পদগুলি পড়িতে পড়িতে একটি সমীর চঞ্চল
সমুদ্রের উপরিভাগ চক্ষে পড়ে। কিন্তু সমুদ্রের অন্তর্দেশে যে গভীরতা, নিস্তব্ধতা যে
বিশ্ববিস্মৃত ধ্যানশীলতা আছে তা বিদ্যাপতির গীতি তরঙ্গের মধ্যে পাওয়া যায় না।’ বিদ্যাপতি
যে বিপুল সংখ্যক পদে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা রূপায়িত করেছেন, তার মধ্যে রাধার বয়:সন্ধি
অভিসার, প্রেমবৈচিত্র্য ও আপেক্ষপানুরাগ, বিরহ ও ভাবসম্মিলনের পদগুলি বিশেষ উৎকর্ষপূর্ণ।
মিথিলার ঐশ্বর্যপূর্ণ রাজসভায় বিদ্যাপতি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের সাথে সংস্কৃত ও প্রাকৃতের
ভাষা ভাব শব্দ ছন্দ ও অলঙ্কারের খনি থেকে রত্নরাজি আহরণ করে রাধার প্রেম বর্ণনা করেছেন।
ছন্দ অলঙ্কারে, শব্দবিন্যাসে ও বাগবৈদগ্ধে বিদ্যাপতির পদ ‘হীরক খণ্ডের মতো আলোক বিচ্ছুরণে
সহস্রমুখী’, আবার ‘জীবনের আলো ও আঁধার, বিপুল পুলক ও অশান্ত বেদনা, রূপোল্লাস ও ভাবোন্মাদনা,
মিলন ও বিরহ, মাথুর ও ভাব সম্মেলনে’ তার পদ আজো অতুলনীয়।
বিদ্যাপতির পদাবলি রচনায় যে বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তা তার অসংখ্য পদে
লক্ষ করা যায়। রাধার প্রেমলীলার বিচিত্র পরিচয় তার পদে বিধৃত। তার ভাব ভাষা চিত্ররূপ
অলঙ্কার ও ছন্দে পরবর্তীকালের অনেক পদকর্তা বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করেছেন।
বিদ্যাপতি সম্পর্কে
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর :-
১) কার অনুরোধে বিদ্যাপতি কাব্যচর্চা
শুরু করেন?
উঃ দেবসিংহ।
২)বিদ্যাপতি তার অধিকাংশ পদাবলী কোন রাজার রাজ সভায় থাকাকালীন রচনা করেন?
উঃ শিবসিংহ।
৩) বিদ্যাপতির মেয়ের নাম কি?
উঃ দুল্লহি/ দুলহা।
৪) বিদ্যাপতি ভারতীয় সাহিত্য ভান্ডারের কোন কোন গ্রন্থ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন?
উঃ গাথাসপ্তশতী, অমরুশতক, শৃঙ্গারতিলক, শৃঙ্গারশতক প্রভৃতি।
৫) বিদ্যাপতির পদে উল্লিখিত মুসলমান রাজার নাম কী?
উঃ নুসরৎ শাহ।
৬) বিদ্যাপতির কোন সংস্কৃত গ্রন্থের প্রভাব
আজও বর্তমান?
উঃ দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী।
৭) 'বিদ্যাপতিগোষ্ঠী' এই বইটি কার লেখা?
উঃ সুকুমার সেন।
৮) বিদ্যাপতি মিথিলার কোন রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন?
উঃ কামেশ্বর।
৯)বিদ্যাপতি কোন্ রানীর গুনমুগ্ধ ছিলেন?
উঃ লছিমা দেবীর।
১০) বিদ্যাপতি কত জন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা পান?
উঃ ৬ জন রাজা ও এক জন রানীর। মোট ৭ জনের।
১১) বিদ্যাপতির ভাষাকে বিকৃত মৈথিলী কে বলেন?
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১২) বিদ্যাপতিকে 'মৈথিল কোকিল' আখ্যায়িত করেন কে?
উঃ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
১৩) কার মতে বিদ্যাপতির আসল নাম 'বসন্তরায়'?
উঃ জন বীমস।
১৪) কোন পুঁথিতে বিদ্যাপতি কে 'সপ্রতিষ্ঠ সদুপাধ্যায় ঠক্কুর শ্রীবিদ্যাপতিনামাঞ্জয়া'
বলা হয়েছে??
উঃ শ্রীধরের 'কাব্যপ্রকাশ বিবেক'পুঁথিতে।
১৫) "বিদ্যাপতি ভক্ত নহেন, কবি - গোবিন্দদাস যতবড় কবি, ততোধিক ভক্ত" - মন্তব্যটি
কার?
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৬) বিদ্যাপতি কে ' পঞ্চোপাসক হিন্দু' বলে কে প্রচার করেন?
উঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
১৭) 'বিদ্যাপতি বিচার' গ্রন্থটি কার লেখা?
উঃ সতীশচন্দ্র রায়।
১৮) বিদ্যাপতি রচিত প্রথম গ্রন্থ কী?
উঃ ভূপরিক্রমা।
১৯) 'মহাজন পদাবলী' পদসংকলনটি কার?কে কবে প্রকাশ করেন?
উঃ বিদ্যাপতির রচনা।জগবন্ধু ভদ্র,১৮৭৪ খ্রি: প্রকাশ করেন।
২০) 'রসিকসভাভূষন সুখকন্দ' কার উপাধি?
উঃ বিদ্যাপতি।
২১) বিদ্যাপতির জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমাটি কত সালে অভিনীত হয়?
উঃ সিনেমার নাম 'বিদ্যাপতি', ১৯৩৭ খ্রি. তৈরি
হয়। পরিচালক - দেবকী বসু। পাহাড়ী সান্যাল বিদ্যাপতি চরিত্রে অভিনয় করেন।
২২) 'বিদ্যাপতি মিথিলার কবি'— একথা কে প্রচার করেন?
উঃ জন বীমস।
২৩) "নব কবি শেখর" উপাধিটি কার?
উঃ বিদ্যাপতির।
২৪) বিদ্যাপতি তাঁর কোন গ্রন্থে নিজেকে" খেলন
কবি" বলেছেন?
উঃ " কীর্তিলতা" কাব্যে।
২৫) বিদ্যাপতির পদকে" Cosmic imagination" কে বলেছেন?
উঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর "বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা" গ্রন্থে।
২৬) বিদ্যাপতিকে বাইরের কবি কে বলেছেন?
উঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।।
২৭) "বাঙ্গালী বিদ্যাপতির পাগড়ী খুলিয়া ধুতি
চাদর পড়াইয়া দিয়াছে"- কে বলেছেন?
উঃ দীনেশচন্দ্র সেন।
২৮) '' বিদ্যাপতি যে মৈথিল লোকে তাহা একরুপ ভুলিয়াই
গেল। বিদ্যাপতি অনেকের কাছে বাঙালি হইয়া দাঁড়াইলেন।'' - মন্তব্যটি কার?
উঃ খগেন্দ্র নাথ মিত্র।
২৯) বিদ্যাপতিকে 'অভিনব জয়দেব' কে আখ্যা দেন?
উঃ শিব সিংহ।
৩০) পদকল্পতরু - তে বিদ্যাপতির কটি পদ আছে?
উঃ ৮ টি।
৩১) বিদ্যাপতির লেখা কোন গ্রন্থে হর-পার্বতীর কথা রয়েছে?
উঃ শৈবসর্বস্বসার।
৩২) বিদ্যাপতির পদাবলীর বৃহত্তম সংস্করণ কে প্রকাশ করেন?
উঃ দীনেশচন্দ্র সেন।
৩৩) বিদ্যাপতির রচিত নাটক কোনটি?
উঃ গোরক্ষবিজয়।
৩৪) 'কীর্তি পতাকা' কার পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা করেন?
উঃ শিব সিংহের।
৩৫) 'কীর্তিলতা' কার পৃষ্ঠপোষকতায় রচনা
করেন?
উঃ কীর্তি সিংহের।
৩৬) বিদ্যাপতির স্মৃতিশাস্ত্র মূলক রচনা কোনটি?
উঃ দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনী।
৩৭) বিদ্যাপতির পদে গৌড়ীয় বৈষ্ণব প্রভাব নেই কেন?
উঃ তিনি চৈতন্য পূর্ববর্তী কবি হওয়ার দরুন এই প্রভাবের প্রশ্নই আসে না।
৩৮) লিখনাবলী গ্ৰন্থ কোন রাজার আমলে রচিত?
উঃ পুরাদিত্যের আমলে।
৩৯) লেখনবলীর বিষয়বস্তু কি?
উঃ এই রচনায় পত্র লেখার নিয়ম রীতি আলোচিত হয়েছে।
৪০) বিদ্যাপতিকে কোন বিদেশী কবির সাথে তুলনা করা হয়?
উঃ চসার।
৪১) বিদ্যাপতি কার আমলে রাজপন্ডিত হিসাবে নিযুক্ত হন?
উঃ কীর্তিসিংহ।
৪২) কোন গ্রন্থে বিদ্যাপতি মনসার কথা লিখেছেন?
উঃ ব্যাড়ী ভক্তিতরঙ্গিনী।
৪৩) বিদ্যাপতির পদসংকলনের নাম কী?
উঃ মহাজন পদাবলী।
৪৪) বিদ্যাপতি মোট কটি সংস্কৃত নাটক লিখেছিলেন?
উঃ দুটি। যথা - গোরক্ষবিজয় ও মণিমঞ্জুরী।
৪৫) "বিদ্যাপতির কবিখ্যাতিকে বাঙালী পবিত্র হোমাগ্নির মতো রক্ষা করেছে"-
কে বলেছেন একথা?
উঃ অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়।
৪৬) বিদ্যাপতির পদ প্রথম কে সংগ্ৰহ করেন?
উঃ জর্জ গীয়ার্সন।
৪৭) বিদ্যাপতির পদের সংখ্যা কত?
উঃ প্রায় ৯০০ টির মত।
৪৮) বিদ্যাপতির আত্মজীবনী মূলক গ্ৰন্থ কোনটি?
উঃ বিভাগসার।
৪৯) বিদ্যাপতি প্রথম কোন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন?
উঃ ভোগীশ্বর।
৫০) বিদ্যাপতি কোন কোন ভাষায় কাব্য রচনা করেন?
উঃ সংস্কৃত, অবহট্ট, মৈথিলি।
৫১) বিদ্যাপতি বাঙালী নন একথা কে প্রমাণ বলেন?
উঃ রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়।
৫২) বিদ্যাপতির রচনার প্রধান রস কী?
উঃ শৃঙ্গার রস।
৫৩) "বিদ্যাপতির কবিতা দূরগামিনী বেগবতী তরঙ্গসঙ্কুলা নদী" - এটি কার উক্তি?
উঃ বঙ্কিমচন্দ্রের।
৫৪) "বিদ্যাপতির প্রথম অধ্যায়গুলি সমস্ত অলংকার শাস্ত্রেরঅনুযায়ী, কিন্তু মাথুর
ও ভাবসম্মিলনে তিনি ভাবরাজ্যে বাঙালী বৈষ্ণব কবিদের মূলসুর
ধরিয়াছেন"— মন্তব্যটি কার?
উঃ দীনেশচন্দ্র সেন।
৫৫) বিদ্যাপতির হর পার্বতী বিষয়ক পদগুলি কী নামে প্রচলিত?
উঃ মহেশবাণী।
৫৬) বিদ্যাপতির লেখা ইতিহাস গ্রন্থ কোনটি?
উঃ কীর্তিলতা' ও ' কীর্তিপতাকা' (অবহট্ট ভাষায় রচনা )।
৫৭) তিনি কোন গ্রন্থে নিজেকে 'খেলন কবি' বলেছেন?
উঃ 'কীর্তিলতা' তে।
৫৮) হরগৌরী বিষয়ক পদ রচনা করেছেন কোন ভাষায়?
উঃ মৈথিলি ভাষায়।
৫৯) '' বিদ্যাপতির পদাবলী মধুচক্রের মত, ইহার
কুহরে কুহরে মাধুর্য'' - মন্তব্যটি কার?
উঃ আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন।
৬০) তুর্কিরাজের বর্ণনা আছে কোন গ্রন্থে?
উঃ কীর্তিলতা।
৬১) বিদ্যাপতির আত্মপরিচিতমূলক পদের উল্লেখ কোন
গ্রন্থে রয়েছে?
উ: 'পদসমুদ্র' সংকলনে।
বিদ্যাপতির কিছু পদ ও তার পর্যায়
(১) নহাই উঠল তীরে রাই কমলমুখী (পূর্বরাগ)
(২) হাথক দরপণ মাথক ফুল (পূর্বরাগ)
(৩) সখি হে আজ জায়ব মোয়ী (অভিসার)
(৪) অব মথুরাপুর মাধব গেল (মাথুর)
(৫) হরি গেও মধুপুর হাম কুলবালা (মাথুর)
(৬) চির চন্দন উড়ে হার না দেলা (মাথুর)
(৭) এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর (মাথুর)
(৮) প্রেম অঙ্কুর জাত আত ভেল (মাথুর)
(৯) অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব (মাথুর)
(১০) পিয়া যব আয়ব এ মঝু গেহে (ভাবোল্লাস)
(১১) আজু রজনী হাম ভাগে পোহায়লু (ভাবোল্লাস)
(১২) কি কহব রে সখি আনন্দ ওর (ভাবোল্লাস)
(১৩) মাধব বহুত মিনতি করি তোয় (প্রার্থনা)
(১৪) তাতল সৈকত বারিবিন্দু সম (প্রার্থনা)
পদাবলীর চণ্ডীদাস (১৩৭০-১৪৩০) :
মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবি। তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী
রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। চৈতন্যদেবের জন্মের আগে থেকেই চণ্ডীদাসের
নামোল্লেখিত বহু গীতিপদ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চৈতন্যদেব নিজে তাঁর পদ আস্বাদন করতেন।
শ্রুতি আছে, রজকিনী রামী তাঁর সহজসাধনের সঙ্গিনী ছিলেন।
চণ্ডীদাস-সমস্যা :
বাংলা ভাষায় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রায় ১২৫০ টির অধিক কাব্যের সন্ধান
পাওয়া গেছে যেখানে রচয়িতা হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস তিনটি
ভিন্ন নামের উল্লেখ রয়েছে আবার কোনোটিতে রচয়িতার নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি।
এ কাব্যগুলো ভণিতা নামে পরিচিত। ভণিতা একই ব্যক্তি কর্তৃক রচিত কিনা তা পরিষ্কার করে
জানা যায় না। আধুনিক পণ্ডিতরা ধারনা করে থাকেন, বর্তমান যে সকল কবিতা চণ্ডীদাসের নামে
রয়েছে তা অন্তত চারজন ভিন্ন চণ্ডীদাস কর্তৃক রচিত হয়েছে। ভণিতা কাব্যের রচনাশৈলী
অনুযায়ী তাদের পৃথক করা যায়।
প্রথম চণ্ডীদাস হিসেবে পদাবলীর চণ্ডীদাসকে ধারণা করা হয় যিনি আনুমানিক ১৪ শতকে বীরভূম
জেলায় (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ) জন্ম নেন; তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী
রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। কারও কারও মতে, তিনিই মধ্যযুগীয় বাংলা
কবিতার অন্যতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। তবে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক
তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া
জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। এই কাব্যে কবি নিজেকে অনন্ত বড়ু চন্ডীদাস
হিসাবে ভণিতা দিয়েছেন। তাঁর আসল নাম অনন্ত, কৌলিক উপাধি বড়ু, এবং গুরুপ্রদত্ত নাম
চণ্ডীদাস। তিনি বাসলী/বাশুলী দেবীর উপাসক ছিলেন (বীরভূমের নানুরে এই দেবীর মন্দির আছে)।
"বড়ু" শব্দটি "বটু" বা "বাড়ুজ্যে" (বন্দ্যোপাধ্যায়)
শব্দের অপভ্রংশ বলে মনে করা হয়।
চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ
স্থানীয় প্রবাদের উল্লেখ করেছেন — বীরভূমের নানুরে বাশুলীদেবীর মন্দিরের কাছে চণ্ডীদাসের
কীর্তন দলের একটি নাট্যশালা ছিল। চণ্ডীদাস একবার গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাওয়ার
অনুরোধ রক্ষা করতে সেখানে যান। তাঁর কণ্ঠে ভক্তি-প্রেমের গান শুনে নবাবের বেগম মুগ্ধ
হয়ে যান এবং তিনি চণ্ডীদাসের গুণের অনুরাগিণী হয়ে পড়েন। বেগম একথা নবাবের কাছে স্বীকার
করলে নবাব ক্রোধের বশে চণ্ডীদাসকে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেন। আত্মীয় বন্ধুবর্গের সামনে
চণ্ডীদাস হস্তিপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে নিদারুণ কশাঘাত সহ্য করে প্রাণবিসর্জন দেন; বেগম সেই
দৃশ্য দেখে শোকে মুর্চ্ছিতা হয়ে প্রাণবিয়োগ করেন। কথিত আছে, শূদ্র কন্যা রামীর সঙ্গে
তার প্রেম ছিল বলে স্থানীয় লোকজন তাকে মেরে তার বাড়িতে চাপা দিয়ে দেয়। আবার কারও
মতে তিনি সেই সময়ের বৈষ্ণব পীঠস্থান ইলামবাজারে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
দীন চণ্ডীদাস এবং দ্বিজ চণ্ডীদাস নামক ভণিতার দুইজন কবিকে চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কবি
বলে ধারণা করা হয়। তবে এই নামদুটি ভনিতার হেরফের মাত্র বলেই অনুমিত হয়।
চণ্ডীদাসের কিছু
পদ ও তার পর্যায়
(১) সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম (পূর্বরাগ)
(২) রাধার কি হইল অন্তরে ব্যথা (পূর্বরাগ)
(৩) ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার (পূর্বরাগ)
(৪) একে কুলবতী ধনি। (পূর্বরাগ)
(৫) এমন পীড়িতি কভূ নাহি দেখি শুনি (পূর্বরাগ)
(৬) কাহারে কহিব মনের মরম (পূর্বরাগ)
(৭) এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা (অভিসার)
(৮) যত নিবারিয়ে চাই নিবার না যায় গো (আক্ষেপানুরাগ)
(৯) বঁধু, কি আর বলিব তোরে (আক্ষেপানুরাগ)
(১০) কি মোহিনী জান বঁধু (আক্ষেপানুরাগ)
(১১) তোমারে বুঝাই বঁধু তোমারে বুঝাই (আক্ষেপানুরাগ)
(১২) মন মোর আর নাহি লাগে গৃহ কাজে (আক্ষেপানুরাগ)
(১৩) কাল জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে (আক্ষেপানুরাগ)
(১৪) বঁধু কি আর বলিব আমি (নিবেদন)
(১৫) বঁধু তুমি যে অ্যাম্বার প্রাণ (নিবেদন)
(১৬) ললিতার কথা শুনি হাসি হাসি বিনোদিনী (মাথুর)
(১৭) রাইয়ের দশা সখীর মুখে (মাথুর)
গোবিন্দ দাস
“আধক আধ-আধ দিঠি অঞ্চলে যব ধরি পেঁখলু কান। কত শত কোটি কুসুমশরে জরজর রহত কি জাত পরান।।”
(গোবিন্দদাস কবিরাজ)
চৈতন্য-উত্তর বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস কবিরাজ। ষোড়শ শতাব্দীর
বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা বলা চলে একাধারে সাধক, ভক্ত ও রূপদক্ষ এই কবিকেই।
যৌবনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন গোবিন্দদাস। অতঃপর রূপ গোস্বামীর
উজ্জ্বলনীলমণি আয়ত্ত্ব করে বৈষ্ণব রসশাস্ত্র অনুসারে রচনা করতে থাকেন রাধাকৃষ্ণ-লীলা
ও চৈতন্য-লীলার পদাবলি। তাঁকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। যদিও বিদ্যাপতির রচনার
সঙ্গে তাঁর রচনার সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য দুইই চোখে পড়ে। তাঁর একটি পদ ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে
বনি’ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সুরারোপিত হয়ে আধুনিক অ-বৈষ্ণব সমাজেও
সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
গোবিন্দদাসের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ভক্তমাল গ্রন্থ, নরহরি চক্রবর্তীর
ভক্তিরত্নাকর ও নরোত্তমবিলাস (এই গ্রন্থদ্বয়ে
কবির রচিত অধুনালুপ্ত সঙ্গীতমাধব নাটকের অংশবিশেষ উদ্ধৃত) ও রামগোপাল দাসের রসকল্পবল্লী
কবির সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানা যায়। তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া
মহকুমার অন্তর্গত শ্রীখণ্ডে এক বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চিরঞ্জিত সেন ছিলেন
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ। জন্মকাল সঠিক জানা না গেলেও গবেষকেরা অনুমান করেন যে
তিনি ষোড়শ শতকে মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চিরঞ্জিত সেন ভক্তকবি দামোদর সেনের কন্যা
সুনন্দাকে বিবাহ করে স্বগ্রাম কুমারনগর ত্যাগ করে বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখণ্ডে বসবাস শুরু
করেন। সুনন্দা দেবীর গর্ভেই নৈয়ায়িক রামচন্দ্র ও তাঁর ছোটো ভাই কবিরাজ গোবিন্দদাসের
জন্ম। প্রথম জীবনে গোবিন্দদাস শাক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। বৈষ্ণবধর্মে তাঁর বিন্দুমাত্র
শ্রদ্ধা ছিল না। যৌবনের শেষভাগে গ্রহণী রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মনে কৃষ্ণভক্তির উদয়
হয়। তখন তাঁর দাদা রামচন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় শ্রীনিবাস আচার্য গোবিন্দদাসকে বৈষ্ণবমন্ত্রে
দীক্ষিত করেন। গোবিন্দদাসের বয়স তখন ৪০। গদাধর প্রভুর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে শ্রীনিবাস
আচার্য বৃন্দাবনে চলে গিয়েছিলেন। শ্রীখণ্ডের রঘুনাথ ঠাকুরের আদেশে রামচন্দ্র তাঁকে
ফিরিয়ে আনতে যান। যাওয়ার আগে গোবিন্দদাসকে অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলার কাছে
তেলিয়া-বুধরী গ্রামে যেতে নির্দেশ দেন। শ্রীনিবাস আচার্য ফিরে এলে তিনি গোবিন্দদাসের
কাছে কিছুকাল অবস্থান করেন। এই সময় তিনি গোবিন্দদাসের স্বমুখে তাঁর রচিত পদাবলি গান
শুনতেন। এই সময়েই শ্রীনিবাস আচার্যের অনুরোধে গোবিন্দদাস গীতামৃত রচনা করেন। মুগ্ধ
শ্রীনিবাস আচার্য তাঁকে ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি বৃন্দাবনে তীর্থে গিয়ে
জীব গোস্বামী, গোপাল ভট্ট প্রমুখের সম্মুখে নিজের পদাবলি গান করেন। ফিরে এলে ভক্তগণ
তাঁকে নিয়ে মহোৎসব করেন। এই সময় নরোত্তম ঠাকুরের পিতৃব্যপুত্র রাজা সন্তোষ দেবের
অনুরোধে তিনি ভক্তিমূলক নাটক সঙ্গীতমাধব রচনা করেন। গোবিন্দদাসের পুত্র দিব্যসিংহও
পিতার ন্যায় ভক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত তিনি জীবিত
ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর শেষজীবন তেলিয়া-বুধরীর পশ্চিমপাড়াতেই অতিবাহিত হয়েছিল।
গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যের কবি, রূপানুরাগের কবি। তিনি ভক্তি ও রূপের মধ্যে এক নিবিড়
ঐক্যসাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পদগুলি ভাষা, অলংকার ও ছন্দের সৌন্দর্যে এবং ভাবের
গভীরতায় পরিপূর্ণ। রূপসৌন্দর্যের ভাবপ্রতিমা সৃজনে তিনি কতদূর সক্ষম হয়েছিলেন তা
পূর্বরাগের এই পদটির বর্ণনা থেকেই পরিস্ফুট হয় –
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।।
এই তীব্র রূপাসক্তিই ছিল গোবিন্দদাসের কাব্যরচনার মূল। তাঁর ভক্তি যত বেড়েছে, যতই
তিনি সাধনার উচ্চস্তরে উপনীত হয়েছেন, ততই এই রূপমুগ্ধতা তাঁকে নিয়ে গেছে পূর্ণতার
দিকে।
রাসাভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে নেই। এই সকল পদে ছন্দে,
সুরে, ভাবে ও ভাষায় যে স্বতঃস্ফুর্ত উল্লাস ঝরে পড়েছে, তা অনুধাবন করতে এই একটি পদই
যথেষ্ট:
শরদ চন্দ পবন মন্দ বিপিনে ভরল কুসুমগন্ধ।
ফুল্ল মল্লিকা মালতী যূথী মত্ত মধুকর ভোরণী।।
হেরত রাতি ওছন ভাতি শ্যামমোহন মদনে মাতি।
মুরলী গান পঞ্চম তান কুলবতী-চিত-চোরণী।।
শুধু রাসাভিসারই নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি নেই।
অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে, অভিসারের পদে গোবিন্দদাস রাজাধিরাজ। সৃষ্টির আদি মুহুর্ত
থেকে বিবর্তনের পথে মানবজীবনের অগ্রগতির সঙ্গে অভিসারের ধারণাটি সম্পৃক্ত। অভিসারের
অর্থ নিছক সঙ্কেতস্থানে মিলনার্থে প্রণয়ী-প্রণয়িণীর গুপ্তযাত্রা নয়, অভিসারের অর্থ
কাম্যবস্তু লাভে কঠোর কৃচ্ছসাধন। জয়দেব অভিসারের কথা বলেছেন কোমল-কান্ত সুরে – ‘চল
সখি কুঞ্জং সতিমির পুঞ্জং শীলয় নীল নিচোলম্।’ কিন্তু গোবিন্দদাসের অভিসার অনেক পরিণত।
এই অভিসার সাধনার নামান্তর –
মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি দূরতর বাদল দোল।
বার কি বারই নীল নিচোল।।
সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।
হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।
ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
শুনইতে শ্রবণে মরম মরি জাত।।
দশ দিশ দামিনী দহই বিথার।
হেরইতে উচকই লোচনভার।।
ইথে যদি সুন্দরি তেজবি গেহ।
প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।
গোবিন্দদাস কহ ইথে কি বিচার।
ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার।।
গোবিন্দদাসের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদেও পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ, মাথুর প্রভৃতি
পর্যায় আছে। তাঁর রাধার মধ্যেও বাসকসজ্জা, খণ্ডিতা, মান-অভিমান, কলহান্তরিতা দশা লক্ষিত
হয়। বিদগ্ধ গোবিন্দদাস অন্তর-সংঘাতে বিধ্বস্ত রাধার আত্মগ্লানি, দীনতা, মিনতি পরিস্ফুট
করেছেন উৎকৃষ্ট ভাব ও ভাষায়। তবে বিরহের পদে তাঁর সার্থকতা নেই। তিনি আরাধনার কবি।
প্রেমের কবি। তাঁর রূপোল্লাসের প্রদীপে বিরহের অন্ধকার অপহৃত হয়েছে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন গোবিন্দদাসের জীবনদেবতা। স্বীয় পদে তিনি এঁকেছেন দিব্যভাবচঞ্চল
মহাপ্রভুর অন্তর্জীবনের ছবি –
নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে পুলক মুকুল অবলম্ব।
স্বেদমকরন্দ বিন্দু বিন্দু চূয়ত বিকশিত ভাবকদম্ব।।
গোবিন্দদাসকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। কবি বল্লভদাস তাঁকে বলেছেন দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।
তবে বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য নিছকই ভাষাগত। ভাবগত নয়। বিদ্যাপতির ভাষা ব্রজবুলি।
গোবিন্দদাসের ভাষাও বাংলা-অনুসারী ব্রজবুলি। এমনকি তাঁর খাঁটি বাংলা পদও দুর্লভ নয়
–
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবনী বহিয়া যায়।
ঈষৎ হাসির তরঙ্গহিল্লোলে মদন মুরছা পায়।।
ছন্দ-অলংকারের ঝংকারে ধ্বনিমাধুর্যে গোবিন্দদাসের পদ বিদ্যাপতির সমতুল। কিন্তু বিদ্যাপতির
পদে ভক্তের আকুতি অনুপস্থিত। তিনি জীবনরসিক কবি। মনে রাখতে হবে, ধর্মক্ষেত্রে বিদ্যাপতি
ছিলেন শৈব। গোবিন্দদাস, অন্যদিকে, স্বয়ং বৈষ্ণবই শুধু নন, ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব ধর্মনেতাদের
অন্তরঙ্গও বটে। চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের অন্যতম রসভাষ্যকার গোবিন্দদাস কবিরাজ।
বিদ্যাপতি সভাকবি, গোবিন্দদাস ভক্তকবি। স্বভাবতই, বিদ্যাপতির পদে আছে বুদ্ধির দীপ্তি,
রাজকীয় আভিজাত্য। সেখানে ভক্তি এসেছে কদাচিত। কিন্তু গোবিন্দদাসের সব ছন্দ, সব অলংকার,
সকল ধ্বনির এক এবং একমাত্র গতি হল ভক্তি। রাধাকৃষ্ণ-প্রেমলীলার অন্তর্নিহিত সত্যটি
যে সেই জীবাত্মা-পরমাত্মার অপার্থিব সম্পর্ক – সেই বৈষ্ণব তত্ত্বের অনুভূতিরই অন্যতম
প্রকাশস্থল গোবিন্দদাসের পদাবলি। এই প্রসঙ্গে তাঁর অভিসার পর্যায়ের পদগুলির উল্লেখ
করা যেতে পারে – যেখানে তাঁর প্রতিস্পর্ধী কবি বৈষ্ণব সাহিত্যে বিরল।
গোবিন্দদাসের কিছু পদ ও তার পর্যায় :
(১) ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবনি (পূর্বরাগ)
(২) যাঁহা যাঁহা নিকষয়ে তনু তনু জ্যোতি (পূর্বরাগ)
(৩) সহচরী মেলি চললি বররঙ্গিনী (পূর্বরাগ)
(৪) রূপে ভরল দিঠি সোঙ্গারি পরশ বিঠি (পূর্বরাগ)
(৫) সুনয়নী কহত কানু ঘন শ্যামর (পূর্বরাগ)
(৬) আধক আধ আধ দিঠি অঞ্চলে (পূর্বরাগ)
(৭) কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল (অভিসার)
(৮) মন্দির বাহির কঠিন কপাট (অভিসার)
(৯) কুল মরিয়াদ কপাট উদ্ঘাটলু (অভিসার)
(১০) আদরে আগুসরী রাই হৃদয়ে ধরি (অভিসার)
(১১) মাধব কি কহব দৈব বিপাক (অভিসার)
(১২) নামহি অক্রুর ক্রুর নাহি যা সম (মাথুর)
(১৩) পিয়ার ফুলের বনে পেয়ার ভোমরা (মাথুর)
(১৪) যে মুখ নিরখনে নিমিখ না সহই (মাথুর)
(১৫) যাঁহা পহু অরুণ চরণে জাত (মাথুর)
জ্ঞানদাস :
কবি জ্ঞানদাস (শ্রীমঙ্গল, মঙ্গল ঠাকুর বা মদনমঙ্গলা নামেও পরিচিত ছিলেন) একজন মধ্যযুগীয়
বাংলা কবি। তাঁর জন্ম ১৫৬০ সিউড়ী ও কাটোয়ার অন্তর্বর্তী কাঁদরা নামক গ্রামে মঙ্গলাখ্য
বিপ্রবংশে। তিনি ষোল শতকের পদাবলী সাহিত্যের একজন সেরা কবি। তাঁর সুনাম চন্ডীদাস বা
বিদ্যাপতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাঁর জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা জায় না।
তিনি ছিলেন ভক্ত বৈষ্ণব সে জন্য তার পদে ভক্তের আবেগ বেশি পাওয়া যায়। সেকালের বটপত্রে
জ্ঞানদাস সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য আছে।
শ্রীচৈতন্যের জীবনী লিখেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ। তার চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে জানা যায়,জ্ঞানদাস
নিত্যানন্দ শাখার একজন বৈষ্ণব। নিত্যানন্দ ছিলেন চৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং বাংলার বৈষ্ণব
সমাজের খুব বড় নেতা। জ্ঞানদাসের অনেক পদে নিত্যানন্দের ভক্তি ও প্রশংসা আছে। পদগুলো
পড়লে মনে হয় জ্ঞানদাস নিত্যানন্দকে অনেক কাছ থেকেই দেখেছিলেন। নিত্যানন্দের মৃতুর
পর তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী জাহ্নবা দেবী বৈষ্ণব সমাজের নেত্রী হয়েছিলেন। জ্ঞানদাস ছিলেন
জাহ্নবা দেবীর শিষ্য। চৈতন্যের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে বৈষ্ণব গ্রন্থগুলো প্রচারের দায়িত্ব
যাঁরা নিয়েছিলেন, নরোত্তম দাস (আনুমানিক ১৫৪০-১৬১০) তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি রাজশাহী
জেলার খেতুরি নামক স্থানে এক মহা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন এবং উৎসবে বাংলাদেশের সব বৈষ্ণবকে
ডেকেছিলেন। সেই মহামেলায় জ্ঞানদাসও অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তখন নাকি তাঁর বয়স
প্রায় পঞ্চাশ বছর। জ্ঞানদাস বলরাম দাস, গোবিন্দ দাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিদের সমসাময়িক
হতে পারেন।
কারো মতে, তাঁর জন্ম ১৫৩০ সালে; কারো মতে ১৫২০ থেকে ১৫৩৫ সালের মধ্যে। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের
বর্ধমান জেলার কাঁদড়া গ্রামে। নিত্যানন্দের জন্মস্থান একচক্রা বা একচাকা গ্রামের কাছাঁকাছি
এই কাঁদড়া গ্রাম। এখানে জ্ঞানসাসের একটি মঠ আছে। জ্ঞানদাসের মৃত্যু উপলক্ষে প্রতিবছর
পৌষ মাসের পূর্ণিমার সময় এই জায়গায় মেলা হয়। জ্ঞানদাস অবিবাহিত ছিলেন বলে জানা
যায়। অন্যমতে, তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর একটি পুত্র ছিল।
জ্ঞানদাস একজন উৎকৃষ্ট পদাকার ছিলেন। তাঁর কিছু স্মরনীয় পদ আছে। যেমন, রূপ লাগি আঁখি
ঝুরে গুণে মন ভোর, কিংবা সুখের লাগিয়ে এ ঘর বান্ধিলুঁ ইত্যাদি। এই সব পদ বৈষ্ণব সাহিত্যকে
সমৃদ্ধ করেছে। পদাবলীর গুণ ও মান বৃদ্ধিতে জ্ঞানদাসের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ষোল
শতক পদাবলীর স্বর্ণযুগ। জ্ঞানদাস এই স্বর্ণযুগের কবি। ভক্তের অনুভূতিকে কবিতায় প্রকাশ
করার অপূর্ব প্রতিভা তাঁর মধ্যে ছিল।
শব্দব্যবহার ও ভাষাভঙ্গি একই রকম বলে জ্ঞানদাসকে চন্ডীদাসের অনুসারী বলা হয়। অকৃত্রিম
সহজ রচনারীতির দিক থেকে চন্ডীদাসের সঙ্গে তাঁর মিল অবশ্যই আছে। কিন্তু জ্ঞানদাস একজন
সতন্ত্র কবি। আধুনিক কালের গীতিকবিতার বৈশিষ্ট তাঁর পদে পাওয়া যাবে।
জ্ঞানদাসের নামে প্রায় শ'দুয়েক পদ চালু আছে। ব্রজবুলিতেও তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন।
তবে তাঁর বাংলা পদগুলো ব্রজবুলির পদের তুলনায় অনেক ভাল। জ্ঞানদাসের একটি বিখ্যাত পদ
নিম্নরূপ:
“ রূপের পাথারে
আঁখি ডুবিয়া রহিল
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।
ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরান
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর। ”
জ্ঞানদাস সঙ্গীত বিষয়েও একজন বিশেষজ্ঞ। একালে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যেমন নিজেদের লেখার
গানে সুর দিয়েছেন, সেকালে জ্ঞানদাসও একই কাজ করেছেন। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে জ্ঞানদাস বাংলা
সাহিত্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি গান লিখে সুর দিয়েছেন। কীর্তন গানেও তাঁর দক্ষতা ছিল
বলা হয়। কীর্তনের নতুন ঢঙ তিনি তৈরি করেছিলেন।
জ্ঞানদাসের কিছু পদ ও তার পর্যায়
(১) রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর (পূর্বরাগ)
(২) আলো মুঞি জান না (পূর্বরাগ)
(৩) দেইখ্যা আইলাম তার (পূর্বরাগ)
(৪) তুমি কি জান সই কাহ্নুর পিরিতি (পূর্বরাগ)
(৫) পুলক ঢাকিতে করি কত পরকার (পূর্বরাগ)
(৬) কানু অনুরাগে হৃদয় ভেল কাতর (অভিসার)
(৭) মেঘ যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার (অভিসার)
(৮) শ্যাম অভিসারে চলু বিনোদিনী রাধা (অভিসার)
(৯) সুখের লাগিয়া এ ঘর বান্ধিনু (আক্ষেপানুরাগ)
(১০) বঁধু তোমার গরবে গরবিনী আমি (নিবেদন)
প্রশ্নোত্তরে
বৈষ্ণব পদাবলী :
➺ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যর অন্যতম
শ্রেষ্ঠ সম্পদ – বৈষ্ণব পদাবলী।
➺ এ অমর কবিতাবলী সৃষ্টি হয়
– রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে।
➺ পদাবলী সাহিত্যের আদি বাঙালি
কবি কাকে ধরা হয়? >জয়দেব।
➺ বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণব সমাজে
পরিচিত – মহাজন পদাবলী নামে।
➺ বৈষ্ণব পদাবলীর মাহকবি বলা
হয় – বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস।
➺ বৈষ্ণব পদাবলির অধিকাংশ পদ
রচিত – ব্রজবুলি ভাষায়।
➺ ব্রজবুলি ভাষা হলো – একটি কৃত্রিম
ভাষা।
১.বিষ্ণুর উপাসকদের বৈষ্ণব বলে।
২.অনেকগুলি পদের সমষ্টি কে বলে পদাবলী।
৩.সপ্তম শতাব্দীতে আচার্য দণ্ডী 'পদসমুচ্চয়' অর্থে তাঁর কাব্যাদর্শে পদাবলী শব্দটি
ব্যবহার করেন।
৪.মহাভারতের শান্তিপর্বে বৈষ্ণব শব্দটির প্রথম উল্লেখ মেলে।
৫.বৈষ্ণব ভক্তকবিরা তাঁদের উপাস্য দেবদেবীর উদ্দেশ্যে ভক্তিমূলক যে পদগুলি রচনা করেছেন
সেগুলিকেই একত্রে বৈষ্ণব পদাবলী নামে পরিচিত।
৬.বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা ও ব্রজবুলি এই দুই ভাষায় লেখা।
৭.ব্রজবুলি মৈথিলী, বাংলা, অবহটঠ এই তিন ভাষার সংমিশ্রনে তৈরি হয়েছে।
৮.ব্রজবুলি ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কাব্যের নাম 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'।
৯.ব্রজবুলি ভাষায় প্রথম পদ লেখেন যশোরাজ খাঁ।
১০.পদাবলী সাহিত্যের সূচনা ধরা হয় জয়দেব থেকে।
১১.রূপ গোস্বামীর লেখা বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের সর্বাধিক প্রামাণিক গ্রন্থ দুটি হল 'ভক্তিরসামৃতসিন্ধু'
এবং 'উজ্জ্বলনীলমণি'।
১২.বিদ্যাপতিকে অভিনব জয়দেব বলা হয়।
১৩.গৌরচন্দ্রিকা বিষয়ক প্রথম পদ লেখেন রাধামোহন ঠাকুর।
১৪.ষোড়শ শতককে বৈষ্ণব পদসাহিত্যের সুবর্ন যুগ বলা হয়।
১৫.বিদ্যাপতিকে মৈথিলী কোকিল বলা হয়।
১৬.গৌরচন্দ্রিকা বিষয়ক পদ প্রথম গাওয়া হয় খেতুরীর মহোৎসবে।
১৭.গোবিন্দদাস কবিরাজ অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি।
১৮.মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি।
১৯.প্রার্থনা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি।
২০.পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন চণ্ডীদাস।
২১.আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস।
২২.রাধার কয়েকজন দূতীর নাম হল বায়বী,শিবদা,পৌরবী।
২৩. রাধার কয়েকজন সখী হল ললিতা,বিশাখা, চম্পকললিতা,ইন্দুলেখা, তুঙ্গবিদ্যা।
২৪.গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের পথিকৃৎ হলেন মাধবেন্দ্রপুরী।
২৫.রাধার পিতামহের নাম মহীভানু।
২৬.রাধার পিতার নাম বৃষভানু এবং মাতার নাম কীর্তিদা।
২৭.গোবিন্দদাস কবিরাজকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলা হয়।
২৮.জ্ঞানদাসকে চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়।
২৯.প্রাকচৈতন্য যুগের দুজন পদকর্তা হলেন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস।
৩০.চৈতন্য উত্তর দুজন পদকর্তা হলেন জ্ঞানদাস,গোবিন্দদাস।
৩১.ষোড়শ শতকের কয়েকজন পদকর্তা হলেন নরহরি সরকার, লোচন দাস,জ্ঞানদাস,বলরাম দাস।
৩২.সপ্তদশ শতকের কয়েকজন পদকর্তা হলেন গোবিন্দদাস, নরোত্তম দাস।
৩৩.সপ্তদশ শতকের কয়েকটি বৈষ্ণব পদসংকলন হল নন্দ কিশোর দাসের 'রসপুষ্পকলিকা',পীতাম্বর
দাসের 'রসমঞ্জরী', মনোহর দাসের 'দিনমণিচন্দ্রোদয়'।
৩৪.অষ্টাদশ শতকের কয়েকটি বৈষ্ণব কাব্য সংকলন হলj রাধামোহন ঠাকুরের 'পদামৃতসমুদ্র',
দীনবন্ধু দাসের 'সঙ্কীর্তনামৃত',গোকুলানন্দ সেনের'পদকল্পতরু'।
৩৫.বৈষ্ণবপদে আট রকমের নায়িকা দেখা যায়।যথা -অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, উৎকন্ঠিতা,বিপ্রলব্ধা,
খণ্ডিতা, কলহান্তরিতা, প্রোষিতভর্তৃকা, স্বাধীনভর্তৃকা।
৩৬.বৈষ্ণব সাহিত্যে আট রকমের অভিসার লক্ষ্য করা যায়,যথা-জ্যোৎস্নাভিসার,তামসাভিসার,
বর্ষাভিসার,দিবাভিসার,কুজ্ঝটিকাভিসার,তীর্থযাত্রাভিসার,উন্মত্তাভিসার,অসমঞ্জভিসার।
৩৭.মধুর রসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-সাধারণী, সমঞ্জস্য,সমর্থা।
৩৮.কবি কর্ণপুর পূর্বরাগের দর্শনজাত অনুরাগ তিন রকম হতে পারে বলে মনে করেন।যথা-সাক্ষাৎদর্শন,চিত্রপটে
দর্শন,স্বপ্নে দর্শন।
৩৯.কবি কর্ণপুর পূর্বরাগের শ্রবণজাত অনুরাগ পাঁচ রকম হতে পারে বলে মনে করেন।যথা-বন্দীমুখে
শ্রবণ, দূতী মুখে শ্রবণ, সখী মুখে শ্রবণ, গুণিজন দের মুখে শ্রবণ, বংশীধ্বনি শ্রবণ।
৪০.শ্রীচৈতন্যের অন্যতম প্রধান পার্শ্বচর ছিলেন নিত্যানন্দ।
৪১.বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন বিদ্যাপতির কবিতা 'স্বর্ণহার'এবং চণ্ডীদাসের কবিতা
'রুদ্রাক্ষমালা'।
৪২.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাপতিকে 'সুখের কবি' এবং চণ্ডীদাসকে 'দুঃখের কবি' বলেছেন।
৪৩.মহাপ্রভুর লীলার প্রত্যক্ষদ্রষ্টা ছিলেন বাদুদেব ঘোষ।
৪৪.জ্ঞান দাসের ভণিতায় ৪০০টি পদ পাওয়া গেছে।
৪৫.রূপ গোস্বামী তাঁর 'উজ্জ্বলনীলমণি'গ্রন্থে কৃষ্ণ প্রেমিকাদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ
করেছেন।যথা-স্বকীয়া,পরকীয়া।
৪৬.ড.সুকুমার সেন বৈষ্ণব পদাবলীর চারটি বিভাগ করেছেন, যথা-গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদাবলী, ভজন
পদাবলী, রাগাত্মিকা পদাবলী, রাধাকৃষ্ণ পদাবলী।
৪৭.গৌড়ীয় বৈষ্ণবগন শ্রীরাধাকে কৃষ্ণের 'হ্লাদিনী শক্তি' বলে অভিহিত করেছেন।
৪৮.বৈষ্ণব সাহিত্যে পঞ্চরস হল-শান্ত,দাস্য,সখ্য,বাৎসল্য, মধুর।
৪৯.বলরাম দাস হলেন বাৎসল্য রসের শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব পদকর্তা।
৫০.পদাবলীর চণ্ডীদাস 'চণ্ডীদাস' ছাড়াও 'দ্বিজচণ্ডীদাস' ভণিতায় পদ লিখেছেন।
৫১.বিদ্যাপতি অনেক পদে 'কবিরঞ্জন' ভণিতা ব্যবহার করেছেন।
৫২.শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকাল বলুন। >১৪৮৬-১৫৩৩খ্রিঃ।
৫৩.বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাচীনতম ব্রজবুলী পদকার কে? >যশোরাজ খাঁ।
৫৪.দু’জন চৈতন্য সমসাময়িক পদকারের নাম করুন। >ক.মুরারি গুপ্ত।খ.শিবানন্দ সেন।..
৫৫.গৌরচন্দ্রিকার জনক কে? >নরহরি সরকার।
৫৬.সপ্তদশ শতকের দু’জন পদকারের নাম করুন। >ক.সৈয়দ মর্তুজা।খ.নসির মামুদ।..
৫৭.ঘোষ ভাতৃত্রয় কারা? >ক.গোবিন্দ ঘোষ খ.মাধব ঘোষ গ.বাসু ঘোষ।
৫৮.চারজন ব্রজবুলি পদকারের নাম করুন। >ক.বিদ্যাপতি খ.গোবিন্দদাস গ.বলরাম দাস ঘ.জ্ঞানদাস।।..
৫৯.বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্তর্গত শাখা গুলির নাম করুন। >ক.চৈতন্যজীবনী সাহিত্য খ.পদাবলী
সাহিত্য গ.বৈষ্ণব তত্ত্ব সাহিত্য।
৬০.বৈষ্ণব পদাবলীতে মুখ্য রস কয়টি? >পাঁচটি। শ্রেষ্ঠ কোনটি? >শৃঙ্গার বা মধুর।
৬১.কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান;কার কোন পর্যায়ের পদ? >চণ্ডীদাসের।আক্ষেপানুরাগ
পর্যায়ের।
৬২.সংগীত মাধব কার লেখা গ্রন্থ? >গোবিন্দদাসের।
৬৩.দ্বিতীয় বিদ্যাপতি কার আখ্যা? >গোবিন্দদাস। কে দিয়েছেন? >বল্লভ দাস।
৬৪.চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য কে? >জ্ঞানদাস।তিনি কার শিষ্যত্ব নেন? >জাহ্নবা দেবীর।
৬৫.বাৎসল্য রসের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কে? >বলরাম দাস।
৬৬.দুইটি পদাবলী সংকলন গ্রন্থের নাম করুন। >ক্ষণদাগীতচিন্তামণি ও পদকল্পতরু।
৬৭.আদি পদাবলী সংকলন ও শ্রেষ্ঠ পদাবলী সংকলনের নাম করুন।
>যথাক্রমে,ক্ষণদাগীতচিন্তামণি ও পদকল্পতরু।
৬৮.যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল;কার পঙক্তি? >জ্ঞানদাসের।
৬৯.নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে;কার কোন পর্যায়ের পদ?
>গোবিন্দদাসের।গৌরাঙ্গ-বিষয়ক।
৭০.অভিসার;গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ;রূপানুরাগ এই পর্যায়গুলির শ্রেষ্ঠ কবি কারা?
>যথাক্রমে,গোবিন্দদাস,গোবিন্দদাস,জ্ঞানদাস।
মঙ্গলকাব্য
➺ বংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বিশেষ
এক শ্রেণির ধর্ম বিষয়ক অখ্যান কাব্যহ হলো – মঙ্গলকাব্য।
➺ প্রকৃতপক্ষে মঙ্গলকাব্যকে দুটি
শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – পৌরণিক ও লৌকিক।
➺ মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য বিষয়
– দেবদেবীর গুণগান।
➺ মধ্যযুগের অন্যতম সাহিত্য
– মঙ্গলকাব্য।
➺ আদি মঙ্গলকাব্য হিসেবে পরিচিত
– মনসামঙ্গল।
➺ একটি সম্পূর্ণ মঙ্গলকাব্যে
সাধারণত – ৫ টি অংশ থাকে।
➺ মঙ্গল কাব্যের প্রধান ধারা
– মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল।
মনসামঙ্গল
মঙ্গলকাব্য গুলির মধ্যে সর্বাধিক প্রাচীন হল মনসামঙ্গল কাব্য ধারা। মনসা দেবী অনার্য
হলেও সাংস্কৃতিক ডামাডোলের যুগে তাঁর আর্যীকরণ করা হয়। যদিও তাতে বাংলার লোকজ কৃষ্টিকালচার
পিছু ছাড়েনি। সেই সময়ের গ্রাম বাংলার আর্থসামাজিক রাজনৈতিক চিত্র জানতে এই কাব্যের
গুরুত্ব আছে বৈকি।
চাঁদসদাগর
মনসামঙ্গল কাব্য ধারা আরেকটি কারণেও পরিচিত সেটি হল চাঁদ সদাগরের চরিত্র অঙ্কন। 'ভাঙবো
তবু মচকাবো না' এই ধনুকভাঙ্গা পণ করে তিনি একাই দেবশক্তির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়েছিলেন।
ফলে পরবর্তীতে এই চরিত্রের কত বার যে বাংলায় পূনর্নির্মান হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। শম্ভু
মিত্রের নাটক 'চাঁদ বণিকের পালা'র আমরা উল্লেখ করতে পারি। মধ্যযুগের অন্য কোনো চরিত্রের
এতবার পূনর্নির্মাণ হয়নি বোধয় আর।
আদি কবি :
মঙ্গলকাব্যের আদি কবি হলেন হরি দত্ত।
তাঁর উল্লেখ করেন কবি বিজয় গুপ্ত এবং কবি পুরুষোত্তম। তবে বিজয় গুপ্তের উল্লেখে কবিসুলভ
সম্মান প্রদর্শন নেই।তাঁর কাব্যের নাম হল পদ্মার সর্পসজ্জা
বিজয় গুপ্ত :
পূর্ববঙ্গের ভীষণই জনপ্রিয় কবি।
জন্ম-বরিশালের গৈলা
গ্রন্থনাম- পদ্মাপূরাণ
পৃষ্ঠপোষক -হোসেন শাহ
সম্পাদনা- প্যারীমোহন দাশগুপ্ত
নারায়ণ দেব :
পূর্ববঙ্গীয় কবি।
গ্রন্থনাম- পদ্মাপুরাণ, সুকন্নানি
সম্পাদনা-ভৈরব চন্দ্র শর্মা
উপাধি- সুকবিবল্লভ,কবিসার্বভৌম
বিপ্রদাস পিপলাই :
পশ্চিমবঙ্গীয় কবি।
কাব্যনাম-মনসাবিজয়,মনসামঙ্গল, মনসাচরিত
কলকাতা সহ বিভিন্ন ঘাটের বর্ণনা বর্তমান কাব্যে।
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ :
পশ্চিমবঙ্গীয় কবি।
কাব্যনাম- ক্ষেমানন্দী
সম্পাদনা-যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য
তন্ত্রবিভূতি
উত্তরবঙ্গীয় কবি।
জগজ্জীবন ঘোষাল
উত্তরবঙ্গীয়।
তন্ত্রবিভূতি ও জগজ্জীবনের কাব্যে মিল বর্তমান।
দ্বিজ বংশীদাস :
পূর্ববঙ্গীয়।
রামায়ণ অনুবাদক চন্দ্রাবতীর পিতা।
শাক্ত ও বৈষ্ণব প্রভাব বিদ্যমান।
জীবন মৈত্র :
কাব্য-পদ্মাপুরাণ
উপাধি-কবিভূষণ
বিষ্ণুপাল
কাব্য-অষ্টমঙ্গলা
ষষ্ঠীবর দত্ত
কাব্য-পদ্মাপুরাণ
উপাধি- গুণরাজ খাঁ
এনার কাব্যে ফারসির ব্যবহার আছে।
সীতারাম দাস
ধর্মমঙ্গলের প্রভাব বিদ্যমান তাঁর কাব্যে।
রসিক_মিশ্র
কাব্য-জগতীমঙ্গল
মাণিক দত্ত
ধর্মমঙ্গলের প্রভাব আছে কাব্যে।
মনসামঙ্গল কোথায় কী নামে পরিচিত :
১.রাঢ়-ঝাপান
২.দক্ষিণবঙ্গ -ভাসান
৩.পূর্ববঙ্গ-রয়ানী
৪.উত্তরবঙ্গ- সাইটোল বিষহরীর গান বা ডগজিয়ানী পালা বা মড়াজিয়ানী পালা
বাইশা
সাধারণ ভাবে বাইশ কবির কবিতা সংকলন।
এর উল্লেখযোগ্য কবিঃ
নারায়ণ দেব,ষষ্ঠীবর দত্ত প্রমুখ
**প্রকাশক- আশুতোষ ভট্টাচার্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
ষট কবি
বাইশার মতোই। ছয় কবির সংকলন।
বারোমাস্যা
এটি মধ্যযুগের প্রায় সব কাব্য ধারাতেই পাওয়া যায়,এমনকি রোমান্স-উপাখ্যান ধারাতেও। কেবল
পীর-সাহিত্যে ব্যতিক্রম লক্ষিত হয়।
বারোমাসের চিত্রাঙ্কন থাকে এখানে নায়িকার জীবনকে কেন্দ্র করে।
চৌতিশা
এটিও মধ্য যুগের কাব্যধারায় প্রায়শই লক্ষ করা যায়,এমনকি পুঁথিসাহিত্যও এর ব্যতিক্রম
নয়।
এতে বাংলা বর্ণমালার ক্রমানুসারে চৌত্রিশটা বর্ণে মন্ত্রজপ করা হয় ইষ্টদেবতার নামে।
কোথাও কোথাও আল্লাহর নামেও এইভাবে চৌতিশা তৈরি করতে দেখা যায়।
প্রশ্নোত্তরে মনসামঙ্গল
:
👉 বাংলা সাহিত্যে মঙ্গল কাব্যের প্রাচীনতম ধারা – মনসামঙ্গল।
👉 মঙ্গলকাব্যের আদি কবি – কানাহরি দত্ত।
👉 মনসামঙ্গলেরর একমাত্র পশ্চিমবঙ্গীয় কবির নাম – কতকাদাস ক্ষেমানন্দ।
👉 বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত কাব্যের নাম – মনসাবিজয়।
👉 মনসা মঙ্গল রচিত – মনসা দেবীর কাহিনি নিয়ে রচিত।
👉 সাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার অপর নাম – কেতকা ও পদ্মাবতী।
👉 মনসামঙ্গল কাব্যের অপর নাম – পদ্মপুরাণ।
👉 মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা – কানাহরি দত্ত, নারায়ণদেব, বিজয়গুপ্ত,
বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ।
👉 মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র – চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, লোখিন্দর,
মনসা।
আরো কিছু প্রশ্নোত্তরঃ-
১. জগজ্জীবন ঘোষালের কাব্য কটি
খণ্ডে বিভক্ত?
উঃ ২
২. বিজয় গুপ্তের কাব্য প্রথম কত সাল প্রকাশিত হয়?
উঃ ১৮৯৬
৩. চাঁদ সদাগর এর পিতার নাম কি ছিল?
উঃ বিজয়
৪. কোন কবির কাব্যে চৈতন্য বন্দনা আছে?
উঃ কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যে
৫. কেতকাদাসের প্রকৃত নাম কি?
উঃ ক্ষেমানন্দ
৬. পূর্ববঙ্গে কার কাব্য ক্ষেমানন্দী নামে পরিচিত?
উঃ কেতকাদাস
৭. মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কে?
উঃ কানাহরি দত্ত
৮. বিপ্রদাস পিপলাই কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উঃ চব্বিশ পরগণা
৯. কেতকাদাসের কাব্যের কটি পালা?
উঃ ৫ টি
১০. রঘুনাথ কার ছদ্মনাম?
উঃ বিজয় গুপ্ত
১১. ফুল্লেশ্বর গ্রামের বর্তমান নাম কি?
উঃ গৈলা
১২. উনবিংশ শতাব্দীর মনসামঙ্গল কাব্যের দুজন কবির নাম?
উঃ রঘুনাথ আর জগমোহন মিত্র
১৩. বিজয় গুপ্তের পিতার নাম?
উঃ সনাতন
১১. মনসার সহচরীর নাম কি?
উঃ নেতা ধোপানি
১২. নারায়ণ দেবের “পদ্মপুরাণ” কটি খণ্ডে বিভক্ত?
উঃ ৩
১৩. মনসাকে জাঙ্গুলিতারা বলা হয়েছে কোন গ্রন্থে?
উঃ সাধনমালা
১৪) ষটকবি মনসামঙ্গল কাকে বলে?
উঃ ৬ জন কবির সঙ্কলিত গ্রন্থ
১৫. জগজ্জীবন ঘোষালের মায়ের নাম কি?
উঃ রেবতি
১৬. নারায়ণ দেবের উপাধি কি ছিল?
উঃ সুকবিবল্লভ
১৭. বাণের পিতার নাম কি?
উঃ বিরোচন
১৮. সুকুমার সেন এর মতে মনসামঙ্গলের সবচেয়ে প্রাচীন কবি কে?
উঃ বিপ্রদাস পিপলাই
১৯. বিজয় গুপ্তের মঙ্গলকাব্য কোন ছন্দে রচিত?
উঃ পয়ার ও লাচার
২০. মনসামঙ্গলের প্রধান নারীচরিত্র কী?
উঃ বেহুলা আর সনকা
২১. মনসার ছেলের নাম কি?
উঃ আস্তিক
২২. জাগরণ পালা কার লেখা?
উঃ দ্বিজ বংশীদাস
২৩. কার মনসামঙ্গল ‘অষ্টমঙ্গলা’ নামে পরিচিত?
উঃ বিষ্ণপাল এর কাব্যে মনসা কার কল্পিত মনসা কণ্যা?
২৪. কোন কবির কাব্য ‘বিদ্যাভূষণী মনসা’ নামে পরিচিত?
উ: রামজীবন বিদ্যাভূষণ
২৫. “সনাতন তনয় রুক্মিনী গর্ভজাত” কোন কবি তাঁর সম্পর্কে এ কথা বলেছেন?
উঃ বিজয় গুপ্ত
২৬. মনসামঙ্গল কাব্যের অষ্টাদশ শতাব্দীর কয়েক জন কবির নাম বল?
উঃ জীবন মৈত্র, ষষ্ঠীবর দত্ত, বিষ্ণু পাল
২৭. মনসামঙ্গলের কোন কবির উপাধি ‘গুণরাজ খাঁ’?
উ: ষষ্ঠীবর দত্ত
২৮. মনসামঙ্গল কাব্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কি?
উঃ ১) আনার্য দেবীরা উচ্চত্বর স্থান পেল।
২) আর্য-আনার্য মিলন ঘটল।
৩) তৎকালীন সমাজ ও ইতিহাসের তথ্য পাওয়া যায়।
২৯. মনসার গান কোথায় ঝাপান নামে পরিচিত?
উঃ রাঢ় বঙ্গে
৩০. “হরিদত্তের গীত যত লোপ পাইল কালে ” – কার রচনা?
উঃ বিজয় গুপ্ত
আরো পড়ুন
৩১. দ্বিজ বংশীদাস কোথাকার কবি?
উঃ পূর্ববাংলার
৩২. সবচেয়ে প্রাচীনতম মঙ্গলকাব্য কোনটি?
উঃ মনসামঙ্গল
৩৩. কার কাছে মনসা দেবী পূজা আদায় করতে পারছিলেন না?
উঃ চাঁদ
৩৪. বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কোথা থেকে কত সালে কার সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়?
উঃ বরিশাল থেকে ১৩০৩ সালে প্যারীমোহন দাসগুপ্তের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
৩৫. মনুষ্যেতর জীবের মধ্যে মনুষত্বের চেতনা আরোপিত হয়েছে কোন মনসামঙ্গল কাব্যে?
উঃ কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গলে মনসার সর্পসয্যা
৩৬. হরি দত্ত রচিত কাব্যের নাম কী?
উঃ কালিকাপুরাণ
৩৭. কোন পর্বতে লখিন্দর – বেহুলার বাসরঘর ছিল?
উঃ সাঁতালি বা সান্তালি পর্বত
৩৮. অন্য কবিরা মনসার জন্ম পদ্মপত্র থেকে হয়েছে বললেও ইনি বলেছেন মনসার জন্ম কেয়া পাতা
থেকে। ইনি কোন কবি?
উঃ কেতকাদাস
৩৯. মনসা পূজা কোন ভাষাভাষীর মানুষেরা প্রথম শুরু করেছিলেন?
উঃ দ্রাবিড়
৪০. কেতকাদাসের কাব্যে বেহুলার ভাসান পথে কটি ঘাটের উল্লেখ আছে?
উঃ ২২
৪১. “বিজয়গুপ্ত দেবতার মাহাত্ম্য রচনা করেন নাই, মানবেরই মঙ্গলগান গাহিয়াছেন” – একথা
কে বলেছেন?
উঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য
৪২. “মূর্খে রচিলা গীত না জানে মাহাত্ম” – কে কার সম্পর্কে একথা বলেছেন?
উঃ বিজয় গুপ্ত কানা হরিদত্ত সম্পর্কে
৪৩. মনসামঙ্গলের কবি হিসাবে নারায়ণ দেবের বিশিষ্টতা কি ছিল?
উঃ তিনি পৌরাণিক কাহিনীর অসামান্য প্রয়োগ ঘটিয়েছেন
৪৪. লখিন্দরের শ্বশুর বাড়ি কোথায়?
উঃ উজানী নগরে
৪৫. কেতকাদাসের কাব্যে কোন কবির প্রভাব আছে?
উঃ মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যের প্রভাব আছে
৪৬. কার কাব্যে চাঁদ সদাগরের বাণিজ্য পথের মধ্যে কলকাতার উল্লেখ আছে?
উঃ বিপ্রদাস পিপলাই
৪৭. অস্ট্রিক দের ভাষাতে মনসা দেবীকে কি বলে?
উঃ মনচঁআ মা
৪৮. ইতিহাস নিষ্ঠার সাথে ভৌগোলিক জ্ঞানের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় কার কাব্যে?
উঃ কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ এর কাব্যে
৪৯. মনসার স্বামীর নাম কি?
উঃ জরুৎকারু মুনি
৫০. কে অন্যান্য মঙ্গল কবিদের মতো স্বপ্নাদেশ প্রাপ্তিতে মঙ্গল কাব্য রচনা করেননি?
উঃ কেতকাদাস
৫১. মুচিনী বেশ নিয়ে মনসা কাকে কাব্য রচনার নির্দেশ দেয়?
উঃ ক্ষেমানন্দ
৫২. কেতকাদাস কোন শতকের কবি?
উঃ সপ্তদশ
৫৩. নারায়ণ দেবের কাব্যে চাঁদসদাগরের কাহিনী আছে কোন খণ্ডে?
উঃ ৩
৫৪. পশ্চিম বঙ্গের কাব্য গুলি কি নামে পরিচিত
উঃ মনসা মঙ্গল
৫৫. কোন্ কবি নিজেকে সুকবিবল্লভ বলেছেন?
উঃ নারায়ণ দেব
৫৬. কে নিজেকে নাটোরের রানি ভবানীর পুত্র রাজা রামকৃষ্ণের আশ্রিত বলে উল্লেখ করেছেন?
উঃ জীবন মৈত্র
৫৭. মাঞ্চাম্মা কোথায় প্রচলিত?
উঃ দক্ষিণ ভারত
৫৮. বিপ্রদাসের কাব্যের কি কি নাম পাওয়া যায়?
উঃ মনসামঙ্গল, মনসাবিজয়, মনসাচরিত
৫৯. বিপ্রদাসের কাব্য কার রাজত্বকালে রচিত?
উঃ হুসেন শাহ
৬০. মনসামঙ্গল কাব্যের কোন কবির কাব্যে আরবি ফারসি শব্দের প্রাধান্য লক্ষ করা য়ায?
উঃ দ্বিজ বংশীদ
চণ্ডীমঙ্গল
👉 চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি – মানিক দত্ত।
👉 চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার কবি দ্বিজ মাধবকে বলা হয় – ‘স্বভাব কবি’।
👉 চণ্ডীমঙ্গল ধারার প্রধান/
শ্রেষ্ঠী কবি – মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
👉 মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর উপাধি – কবিকঙ্কন।
👉 চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত – চণ্ডীদেবীর কাহিনি অবলম্বনে।
👉 মুকুন্দরাম চক্রবর্তীতে ‘কবিকঙ্কন’ উপাধি দেন – জমিদার রঘুনাথ রায়।
👉 চন্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা – মানিক দত্ত, দ্বিজ মাধব, মুকুন্দরাম
চক্রবর্তী, দ্বিজরাম দেব, মুক্তারাম সেন।
👉 চণ্ডীমঙ্গল ধারার প্রধান/
শ্রেষ্ঠী কবি – মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
👉 মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর উপাধি – কবিকঙ্কন।
👉 চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত – চণ্ডীদেবীর কাহিনি অবলম্বনে।
👉 মুকুন্দরাম চক্রবর্তীতে ‘কবিকঙ্কন’ উপাধি দেন – জমিদার রঘুনাথ রায়।
👉 চন্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা – মানিক দত্ত, দ্বিজ মাধব, মুকুন্দরাম
চক্রবর্তী, দ্বিজরাম দেব, মুক্তারাম সেন।
👉 চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র – কালকেতু, ধনপতি, ভাড়ুদত্ত, মুরারী
শীল।
👉 বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঠগ চরিত্র – ভাড়ুদত্ত।
১. কোন পুরানে দেবী চন্ডীর উল্লেখ আছে?
উ: মার্কান্ডেয় পুরানে।
২. চন্ডীমঙ্গলের আরাধ্য দেবতা কে?
উ: দেবী চন্ডী
৩. চন্ডী শব্দটি কী জাতীয়?
উ: দ্রাবিড়
৪. কখন থেকে দেবী চন্ডীর মূর্তির পাশে গোধিকা মূর্তির স্থান লাভ হয়েছে?
উ: দ্বাদশ শতাব্দী থেকে
৫. কালকেতু, ফুল্লরা, শ্রীমন্ত, খুল্লনার পূর্ব পরিচয় লেখ।
উ: কালকেতু - ইন্দ্রপূত্র নীলাম্বর
ফুল্লরা - নীলাম্বর পত্নী ছায়া
শ্রীমন্ত- মালাধর
খুল্লনা- রত্নমালা
৬. চন্ডীমঙ্গলের কয়টি কাহিনী ও কী কী?
উ: ২ টি।
ক. আখেটিক খন্ড - কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনী
খ. বনিক খন্ড - ধনপতি, শ্রীমন্ত ও খুল্লনার কাহিনী
৭. দেবী চন্ডী কোন সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিত হন?
উ: ওঁরাও সম্প্রদায়
মানিক দত্ত :
১. কবির জন্মস্থান কোথায়?
উ: মালদহের ফুলবাড়ি ( কবি কথিত - ফুলুড়া )
২. চন্ডীমঙ্গলের আদি কবি যে মানিক দত্ত তা কীভাবে জানা যায়?
উ: কবি মুকুন্দরামের অভয়ামঙ্গলের থেকে জানা যায় -
" মানিক দত্তরে আমি করিয়ে বিনয়
যাহা হৈতে হৈল গীত পথ পরিচয়।।"
৩. কোন কবি প্রথম যৌবনে কালা ও খোঁড়া ছিলেন?
উ: মানিক দত্ত।
৪. কোন কবির কাব্য ধর্মমঙ্গলের কাহিনীর দ্বারা প্রভাবিত?
উ: মানিক দত্ত।
৫. কোন কবির কাব্য ছড়ার লক্ষনাক্রান্ত?
উ: মানিক দত্ত।
দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য :
১. কার কাব্যে প্রথম পূর্নাঙ্গ চন্ডীমঙ্গলের কাহিনী আছে?
উ: দ্বিজ মাধব
২. কবির জন্মস্থান কোথায়?
উ: সপ্তগ্রাম বা নবদ্বীপ
৩. কবির পিতার নাম কী?
উ: পরাশর
৪. কাব্যটি কখন রচিত? রচনাকাল জ্ঞাপক শ্লোকটি কী?
উ: ১৫০১ শকাব্দ বা ১৫৭৯ খ্রী :
"ইন্দু বিন্দ বাণ ধাতা শক নিয়োজিত।
দ্বিজমাধব গায়ে সারদাচরিত।।"
৫. কাব্যর নাম কী?
উ: " সারদাচরিত " বা "সারদামঙ্গল "।
৬. কাব্যটির মৌলিকতা কী?
উ: গতানুগতিক হর-পার্বতির কাহিনীর বদলে কবি মঙ্লাসুর নামক বধের কাহিনীর সংযোজন।
৭. মঙ্গলচন্ডীর গীত কী?
উ: দ্বিজ মাধবের কাব্যটি মঙ্গলচন্ডীর গীত নামে পরিচিত।
এর কারন কাব্যে দেবী চন্ডীর দ্বারা মঙ্গল নামক অসুর বধের কাহিনী আছে। তাই এরূপ নামকরণ।
৮. কার সম্পাদনায় মঙ্গলচন্ডীর গীত প্রকাশিত হয়?
উ: সূধীভূষণ ভট্টাচার্যের সম্পদনায়।
৯. জাগরন কী? এরূপ নামকরনের কারন কী?
উ: দ্বিজ মাধবের সারদাচরিত চট্টগ্রামে জাগরন নামে পরিচিত।
আটদিন ধরে রাত জেগে লোকে মঙ্গলচন্ডীর গীত শুনত বলে এরূপ নামকরণ।
১০. কোন কবি তার কাব্যে বিষ্ণুপদ যোগ করেছেন?
উ: দ্বিজ মাধব
১১. দ্বিজ মাধবের নামে আর কোন কাব্য প্রচলিত?
উ: গঙ্গামঙ্গল
১২. কৃষ্ণমঙ্গল কাব্যটি কার?
উ: নবদ্বীপবাসী মাধবাচার্যের। এই মাধবাচার্য ও দ্বিজ মাধব একই ব্যক্তি কি না তা বলা
যায় না।
১৩. কবির কাব্য কোথায় প্রচলিত?
উ: পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম, নোয়াখালি ও রঙপুর অঞ্চলে।
১৪. " মাধুর ভাড়ুদত্ত কবিকঙ্কনের ভাড়ুদত্ত হইতে শঠতায় প্রধান " - কে মন্তব্যটি
করেন?
উ: আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন।
মুকুন্দরাম চক্রবর্তী :
১. চন্ডীমঙ্গল কাব্য ধারার শ্রেষ্ট কবি কে?
উ: মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
২. কবির জন্মস্থান কোথায়?
উ: বর্ধমান জেলার দামুন্যা বা দামিন্যা গ্রামে।
৩. কবির পিতা ও মাতার নাম কী?
উ: পিতা - হৃদয় মিশ্র
মাতা - দৈবকী
৪. কবি স্বগ্রাম ত্যাগ করলেন কেনো? ত্যাগ করে কবি কোথায় গেলেন?
উ: ডিহিদার মাহমুদ বা মামুদ শরিফের অত্যাচারের জন্য।
কবি স্বগ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে যান মেদিনীপুরের আরড়া গ্রামের জমিদার বাকুরা রায়ের আশ্রয়ে।
৫. কার নির্দেশে কবি কাব্য রচনা করেন?
উ: বাকুরা রায়ের পূত্র ও একদা তার ছাত্র রঘুনাথ রায়ের নির্দেশে।
৬. কাব্যের নাম কী?
উ: অভয়ামঙ্গল, অম্বিকামঙ্গল, চন্ডীকামঙ্গল
৭. কবির কাব্যটি কটি খন্ডে বিভক্ত?
উ: ৩ টি।
ক. দেবখন্ড
খ. আখেটিক খন্ড
গ. বনিক খন্ড
৮. " পিপীড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে" - প্রবাদটি কার কাব্যে আছে?
উ: মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
৯. কে দুঃখবাদী কবি নামে পরিচিত?
উ: মুকুন্দরাম
১০. " এ যুগে জন্মগ্রহন করিলে একজন স্বার্থক উপন্যাসিক হইতেন " - কে কোথায়
কার সম্পর্কে এই মন্তব্যটি করেছেন?
উ: ডক্টর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার " বঙ্গ সাহিত্যের উপন্যাসের ধারা
" গ্রন্থে কবি মুকুন্দরাম সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন।
১১. কাব্যটি কখন রচিত হয়? শ্লোকটি লেখ।
উ: এ নিয়ে মতভেদ আছে। করো মতে ১৫৪৪-৪৫ খ্রি:। আবার কারো মতে ১৫৭৭ খ্রী:।
" শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গনিতা
কত দিনে দিলা গীত হরের বনিতা।"
১২. কাব্যটি কার সম্পদনায় কবে প্রথম প্রকাশিত হয়?
উ: ১৮২৩-২৪ খ্রী: রামজয় বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় কাব্যটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
দ্বিজ রামদেব :
১. কোথাকার কবি?
উ: চট্টগ্রামের
২. কবির পিতার নাম কী?
উ: কবিচন্দ্র
৩. কাব্যের নাম কী?
উ: " অভয়ামঙ্গল "
৪. কাব্যটি কার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়?
উ: আশুতোষ দাসের।
৫. কবি কোন শতকের?
উ: সপ্তদশ শতক
প্রশ্নোত্তরে চণ্ডীমঙ্গল :
১) চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবির
নাম কী?
উঃ মানিক দত্ত।
২) চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কটি কাহিনী?
উঃ দুটি। আখেটিক খণ্ড ও বণিক খণ্ড।
৩) কালকেতু আসলে কে?
উঃ ইন্দ্র পুত্র নীলাম্বর।
৪) কালকেতুর পিতার নাম কী?
উঃ ধর্মকেতু।
৫) নীলাম্বরের স্ত্রীর নাম কী?
উঃ ছায়া।
৬) ছায়া মর্ত্যে কার ঘরে কী নামে জন্মগ্রহণ করে?
উঃ ফুল্লরা নামে সঞ্জয়কেতুর ঘরে জন্মায়।
৭) কালকেতুর পুত্রের নাম কী?
উঃ পুষ্পকেতু।
৮) উজানী নগরের শ্রেষ্ঠ বণিক কে?
উঃ ধনপতি সওদাগর।
৯)ধনপতি সওদাগর কার উপাসক ছিলেন?
উঃ শিবের উপাসক ছিলেন অর্থাৎ শৈব।
১০) ধনপতি সওদাগরের প্রথম স্ত্রীর নাম কী?
উঃ লহনা।
১১)ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কী?
উঃ খুল্লনা।
১২)খুল্লনা আসলে কে?
উঃ শাপভ্রষ্ট স্বর্গের নর্তকী রত্নমালা।
১৩) চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে যে সিংহল রাজার পরিচয় পাওয়া যায় তার নাম কী?
উঃ শালিবাহন।
১৪) খুল্লনার গর্ভে কার জন্ম হয়?
উঃ স্বর্গের গন্ধর্ব মালাধর শাপভ্রষ্ট হয়ে জন্ম নেয় শ্রীমন্ত নামে।
১৫) দেবী চণ্ডী শ্রীমন্তকে কী মূর্তি দেখান?
উঃ কমলেকামিনী।
১৬)সিংহল রাজকণ্যার নাম কী?
উঃ সুশীলা।
১৭)চৈতন্য যুগের একজন সার্থক চণ্ডীমঙ্গল রচয়িতার নাম লেখ।
উঃ দ্বিজ মাধব বা মাধব আচার্য।
১৮)দ্বিজমাধবের কাব্যের নাম কী?
উঃ সারদামঙ্গল বা সারদাচরিত।
১৯)দ্বিজমাধবের কাব্যের রচনাকাল কত?
উঃ ১৫০১ শকাব্দ বা ১৫৭৯ খ্রীঃ।
২০)দ্বিজমাধবের পরিচয় দাও।
উঃ কবির দেওয়া আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, তিনি ব্রাহ্মণ বংশে জাত। ত্রিবেণীর কাছে
সপ্তগ্রামে তার বাড়ি।
২১) চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবির নাম কী?
উঃ কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
২২) মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের আসল নাম কী?
উঃ অভয়ামঙ্গল।
২৩) মুকুন্দরামকে কবিকঙ্কণ উপাধি কে দিয়েছিলেন?
উঃ কবির আশ্রয়দাতা রঘুনাথ রায়।
২৪) মুকুন্দরামের পিতা ও মাতার নাম কী?
উঃ হৃদয় মিশ্র ও দেবকী।
২৫) কবির পূর্বপুরুষ মাধব ওঝার নিবাস কোথায় ছিল?
উঃ কর্ণপুরে।
২৬) কর্ণপুরে থেকে তারা কোথায় বসতি স্থাপন করেন?
উঃ বর্ধমান জেলার রায়না থানার অধীন দামুন্যা গ্রাম।
২৭) কবিকঙ্কণের পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র;মিশ্র হলেও তাঁদের আসল উপাধি কী ছিল?
উঃ চক্রবর্তী ;রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ, কোয়ারি গাঁঞি।
২৮)কবির জন্মসাল কত?
উঃ আনুমানিক ১৫৪৭ খ্রীঃ।
২৯) মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্য কার সম্পাদনায় প্রথম মুদ্রিত হয়?
উঃ ১৮২৩ খ্রীঃ, রামজয় বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায়।
৩০) অভয়ামঙ্গল কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে কী জানা যায়?
উঃ 'শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গণিতা।
কত দিনে দিলা গীত হরের বনিতা।।'
অর্থাৎ রস =৬, রস =৬, বেদ =৪, শশাঙ্ক = ১। অঙ্কস্য বামাগতি নিয়মানুযায়ী ১৪৬৬শকে বা
১৪৬৬+৭৮=১৫৪৪ খ্রীঃ।
৩১)দীনেশচন্দ্র সেনের মতে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের রচনাকাল -১৫৭৭ খ্রীঃ।
৩২) সেই সময় তালুকদার ছিলেন- গোপীনাথ নন্দী।
৩৩) বাংলার সুবেদার ছিলেন -মানসিংহ।
৩৪) ডিহিদার ছিলেন -মামুদ শরীফ।
৩৫) জমিদার বাঁকুড়া রায় কবিকে নিজপুত্র রঘুনাথ রায়ের শিক্ষার ভার দেন।
৩৬) কবিকঙ্কণের নামে আর একটি গ্রন্থ পাওয়া যায় তার নাম -জগন্নাথমঙ্গল।
৩৭)কাউয়েল সাহেব কবির কাব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
৩৮) 'এযুগে জন্মগ্রহণ করিলে মুকুন্দরাম কবি না হইয়া ঔপন্যাসিক হইতেন' -মুকুন্দরামের
সম্পর্কে অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় একথা বলেন।
৩৯)'এই চরিত্রটি যেন মসৃণ চিক্কন,কাঁঠাল গাছটির মত' কালকেতু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই মন্তব্য করেছিলেন।
৪০) সমালোচকরা মুকুন্দরামকে 'দুঃখবাদী'কবি হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
৪১) অষ্টাদশ শতকের চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের দুজন কবির নাম -অকিঞ্চন মিশ্র ও শ্রীকৃষ্ণজীবন
দাস।
৪২) শ্রীকৃষ্ণজীবন দাসের কাব্যের নাম -অম্বিকামঙ্গল।
৪৩) জয়নারায়ণ রায় রচিত চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের নাম -চণ্ডিকামঙ্গল।
৪৪) রামশঙ্কর দের চণ্ডীমঙ্গলের নাম -অভয়ামঙ্গল।
৪৫) ভবানীশঙ্কর দাসের চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের নাম-মঙ্গলচণ্ডী পাঞ্চালিকা।
৪৬) রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের নাম-দুর্গামঙ্গল।
৪৭)চণ্ডীমঙ্গলের উল্লিখিত ফুল্লরার বারো মাসের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনাজ্ঞাপক চিত্রকেই
বারমাস্যা বলে।
৪৮) চণ্ডীমঙ্গলের দুজন শঠ চরিত্র -ভাড়ু দত্ত ও মুরারী শীল।
ধর্মমঙ্গল
👉 ধর্মঠাকুরের মহত্ম্য
প্রচারের জন্য সূত্রপাত হয়েছে – ধর্মমঙ্গল কাব্যের।
👉 ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার প্রথম কবি – ময়ূর ভট্ট।
👉 ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার প্রধান কবি – রূপরাম চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তী।
👉 ধর্মমঙ্গল কাব্য দুটি পালায় বিভক্ত – রাজা হরিশচন্দ্রের গল্প ও লাউসেনের
গল্প।
১। ধর্মমঙ্গলের কটি কাহিনী ও কি কি?
উঃ -২ টি।ক। রাজা হরিশচন্দ্রের কাহিনী খ। লাউসেনের কাহিনী
২। কে বলেছেন প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ দেবতা?
উঃ –হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
৩। কার মতে ধর্মঠাকুর সূর্য দেবতা?
উঃ – ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
৪। ধর্মঠাকুরের কিসের দেবতা?
উঃ –সন্তান লাভ, কুষ্ঠ নিবারন, আর সেই সাথে ফসল উৎপাদনের দেবতা।
৫। ধর্মের পূজো কোন কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত?
উঃ – ডোম, জেলে, নাপিত ইত্যাদি
৬। ধর্মমঙ্গলেরের প্রাচীন কাহিনী কোনটি?
উঃ – হরিশচন্দ্রের কাহিনী
৭। ধর্মমঙ্গলে কোন যুগের ইতিহাস পাই?
উঃ – পাল যুগের
৮। ধর্মমঙ্গলে ধর্ম কোন কোন দেবতার সংমিশ্রণে ঘটেছে?
উঃ – ডোম জাতির দেবতা সূর্য, বৌদ্ধ নিরঞ্জন ও পৌরাণিক বিষ্ণুর।
৯। কোন মঙ্গল কাব্যের দেবতার নির্দিষ্ট আকৃতি নেই?
উঃ –ধর্মমঙ্গল
১০। ধর্মমঙ্গলের কাহিনী কটি পালায় বিভক্ত?
উঃ – ১২ টি পালায়
১১। লাউসেনের কাহিনী কটি সর্গে বিভক্ত?
উঃ – ২৪ টি
১২। ধর্মমঙ্গলের কোন চরিত্রটি ঐতিহাসিক চরিত্র?
উঃ – ইছাই ঘোষ
১৩। ধর্মমঙ্গলের আদি পুরোহিত কে?
উঃ – রামাই পণ্ডিত
১৪। শূন্যপুরাণ – কে রচনা করেন?
উঃ – রামাই পণ্ডিত
১৫। ধর্মমঙ্গলের আদি কবি কে? গ্রন্থের নাম কি? গ্রন্থটির আসল নাম কি?
উঃ –ময়ূরভট্ট, শ্রীধর্মপুরাণ, আসল নাম হাকন্দপুরান
১৬। ধর্মমঙ্গলের একটি খল চরিত্র?
উঃ –মহামদ
১৭। খেলারাম চক্রবর্তীর কাব্যের নাম কি? রচনাকাল কত?
উঃ – গৌঢ় কাব্য
১৮। রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য ধর্মমঙ্গল – কে বলেছেন?
উঃ – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
১৯। ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যের নাম কি? রচনাকাল কত?
উঃ - অনাদিমঙ্গল, ১৭১১ খ্রিষ্টাব্দ
২০। কোন ধর্মমঙ্গল প্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে?
উঃ - ঘনরাম চক্রবর্তীর অনাদিমঙ্গল
২১। সর্বাধিক প্রচারিত ধর্মমঙ্গলের নাম কি?
উঃ -- ঘনরাম চক্রবর্তীর অনাদিমঙ্গল
২২। রামদাস আদকের ধর্মমঙ্গলের নাম কি?
উঃ – অনাদিমঙ্গল
২৩। ধর্মমঙ্গলের উপাস্য দেবতা কে?
উঃ – ধর্ম দেবতা
২৪। সুকুমার সেনের মতে ধর্মমঙ্গলের প্রথম কবি কে?
উঃ – রূপরাম চক্রবর্তী
২৫। গদ্যের দৃষ্টান্ত বর্তমান কোন গ্রন্থে?
উঃ – শূন্যপুরাণ
২৬। ময়ূরভট্টের গ্রন্থ কে প্রকাশ করেন?
উঃ – বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়
২৭। শূন্যপূরাণের আবিষ্কর্তা কে?
উঃ – নগেন্দ্রনাথ বসু
২৮। শূন্যপুরাণ ছাড়া রামাই পণ্ডিতের অপর একটি গ্রন্থের নাম কি?
উঃ – ধর্মপূজা বিধান
২৯। শূন্যপূরাণের আসল নাম কি?
উঃ – আগম পুরাণ বা রামাই পণ্ডিতের পদ্ধতি
৩০। এ যাবৎ কতজন ধর্মমঙ্গলের কবির কথা জানা যায়?
উঃ – ১৮ জন
১. কত সালে ঘনরাম চক্রবর্তী ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন?
উঃ ১৭১১ খ্রিঃ
২. কবিরত্ন উপাধি কে পান?
উঃ ঘনরাম
৩. ঘনরামের ধর্মমঙ্গলে কয়টি শ্লোক আছে?
উঃ ৯১৪৭ টি
৪. ঘনরামের পিতার মাতার নাম কি?
উঃ গৌরীকান্ত, সীতা
৫. রামদাস আদকের কাব্যের নাম কি?
উঃ আনাদিমঙ্গল
৬. অনাদিমঙ্গল কার লেখা?
উঃ রূপরাম চক্রবর্তী
৭. শ্যাম পণ্ডিত কে ছিলেন?
উঃ ধর্মমঙ্গলের অন্যতম কবি
৮) যদুনাথ রায় কোন কাব্যের কবি?
উ৮. ধর্মমঙ্গল
৯. রামদাস আদক পেশায় কি ছিলেন?
উঃ চাষী
১০. ঘনরাম কার আদেশে কাব্য রচনা করেন?
উঃ বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র
১১. ঘনরামের রচিত অন্য একটি গ্রন্থের নাম কি?
উঃ সত্যনারায়ণ পাঁচালি
১২. খেলরাম চক্রবর্তী কে ছিলেন? তার কাব্যের নাম কি?
উঃ ধর্মমঙ্গলের কবি। গৌড়কাব্য
১৩. ইছাই ঘোষ কে ছিলেন?
উঃ ঢেকুর গড়ের বিদ্রোহী সামন্ত রাজা
১৪. অনিলপুরাণ কার লেখা?
উঃ অনিলকুমার চক্রবর্তী
১৫. আধুনিক কালে ধর্মমঙ্গলের কোন কবিকে “ভৌতিক কবি” বলা হয়?
উঃ ময়ূরভট্ট
১৬. কৃষকদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে কে ধর্মমঙ্গল রচনা করেন?
উঃ অরিন্দম নন্দী
১৭. ধর্মমঙ্গল কাব্যে মোট কয়টি কাহিনী আছে?
উঃ দুটি। ১. রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী, ২. লাউসেনের কাহিনী।
১৮. কতজন কবি ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়?
উঃ ২০ জন।
১৯. ধর্মমঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবি কারা?
উঃ ১. ময়ূরভট্ট ২. আদি রূপরাম ৩. খেলারাম চক্রবর্তী ৪. মানিকরাম ৫. রূপরাম চক্রবর্তী
৬. শ্যাম পণ্ডিত ৭. সীতারাম দাস ৮. রাজারাম দাস ৯. রামদাস আদক ১০. দ্বিজ প্রভুরাম ১১.
ঘনরাম চক্রবর্তী ১২. রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩. সহদেব চক্রবর্তী ১৪. নরসিংহ বসু,
১৫. হৃদয়রাম সাউ প্রমুখ।
২০. ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি কে?
উঃ ময়ূরভট্ট।
২১. ময়ূরভট্টের কাব্যের নাম কি?
উঃ হাকন্দপুরাণ (শ্রীধর্মমঙ্গল কাব্য)।
২২. রূপরামের সময় বাংলার সুবাদার কে ছিলেন?
উঃ শাহসুজা
২৩. ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্যের রচিয়তা কে?
উঃ রামদাস আদক।
২৪. শ্যাম পণ্ডিত কে?
উঃ ধর্মমঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি। তাঁর কাব্যের নাম নিরঞ্জনমঙ্গল।
২৫. বাংলা সাহিত্যর মধ্যযুগের অপ্রধানমঙ্গল কাব্যগুলো কি কি?
উঃ অপ্রধান মঙ্গলকাব্য — ১. শীতলামঙ্গল কাব্য ২. ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্য ৩. সারাদামঙ্গল কাব্য
৪. গৌরীমঙ্গল কাব্য ৫. গঙ্গামঙ্গল কাব্য ৬. রায়মঙ্গল কাব্য ৭. পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য।
আরো পড়ুন
২৬. সারদামঙ্গল কাব্যের বিষয়বস্তু কি?
উঃ বিদ্যা ও চারুকলার অধিষ্ঠিত্রী দেবী সারদা ও সরস্বতীর কাহিনী অবলম্বনে সারদামঙ্গল
কাব্য রচিত।
২৭. শীতলামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কে?
উঃ নিত্যানন্দ চক্রবর্তী।
২৮. মানিকরাম গাঙ্গুলী কোন কাব্যের কবি?
উঃ শীতলামঙ্গল কাব্যের।
২৯. কৃষ্ণরাম রচিত কাব্যের নাম কি?
উঃ রায়মঙ্গল।
৩০. গৌরীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা কে?
উঃ পৃথ্বীরাজ।
৩১. দুর্গামঙ্গল কী অনুসরণে রচিত?
উঃ পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে।
৩২. ঘনরামের কাব্য অনুসারে কত নম্বর পালায় লাউসেন লোহার গণ্ডার দ্বিখণ্ডিত করেন?
উঃ ১৭ নং পালা
৩৩. কে কোন গ্রন্থে ধর্মঠাকুর কে বৌদ্ধদেবতা আখ্যায়িত করেন?
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ”ডিসকভারী অফ লিভিং বুদ্ধিজম অফ বেংগল” নিবন্ধে
ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ দেবতা আখ্যায়িত করেছেন।
৩৪. রামদাস আদক কোন শতাব্দীর কবি? তিনি জাতিতে ও পেশায় কি ছিলেন?
উঃ সপ্তদশ শতাব্দীর কবি। কবি জাতিতে কৈবর্ত হলেও পেশায় ছিলেন কৃষিজীবী।
৩৫. রঞ্জাবতী কোন নদীর তীরে ধর্মের আরাধনা করেন?
উঃ বল্লুকা
৩৬. কার আদেশে চোরেরা লাউসেনকে চুরি করে? এবং তাকে কে উদ্ধার করেন?
উঃ মাহুদ্যা
৩৭. ঘনারামের উপাধি কী ছিল এবং কে এই উপাধি দিয়েছিল?
উঃ কবিরত্ন, গুরু রামদাস
৩৮. কানাড়া কোন রাজার কন্যা?
উঃ শিমুলরাজ হরিপালের রাজকন্যা
৩৯. ‘ধর্ম’ শব্দটি কোন শব্দের রূপ?
উঃ দড়ম
৪০. ঘনরাম চক্রবর্তীর সমসাময়িক বিখ্যাত ধর্মমঙ্গলের কবির নাম কি? তাঁর কাব্যের নাম
কি? তাঁর অন্য একটি বিখ্যাত কাব্যের নাম লেখ?
উঃ মানিক গাঙ্গুলী। তাঁর কাব্য হল শ্রীধর্মমঙ্গল বা বার্মাতি। অন্য একটি বিখ্যাত কাব্য
হল শীতলামঙ্গল।
৪১. রূপরামের কবিকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন কে?
উঃ গণেশ রায়
৪২. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যে কতগুলো পালা আছে
উঃ ২৪
৪৩. সীতারাম দাস কার উৎসাহে কাব্য রচনা করেন
উঃ ইন্দাস গ্রামের পুরোহিত নারায়ণ পণ্ডিতের উৎসাহে।
৪৪. আরামবাগের হয়াৎপুর গ্রামে কোন কবি জন্মগ্রহন করেন?
উঃ রামদাস আদক
৪৫. কে ঘনরাম চক্রবর্ত্রীর পৃষ্টপোষক ছিলেন?
উঃ বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র
৪৬. ধর্মমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে? তাঁর কাব্যের নাম কী? কবির উপাধি কী ছিল?
উঃ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। কাব্যের নাম শ্রীধর্মমঙ্গল। উপাধি কবিরত্ন
৪৭. ঘনরাম চক্রবর্তী কোন রাজার সমসাময়িক ছিলেন?
উঃ বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের সমসাময়িক
৪৮. রঞ্জাবতীর গুরুর নাম কী?
উঃ রামাই পণ্ডিত
৪৯. ধর্মদাস বণিকের ধর্মমঙ্গলের উপর কাজ করে কে ডক্টরেট ডিগ্রী পান?
উঃ সুমিত্রা কুন্ডু।
৫০]
“ধর্মমঙ্গল” কাব্যকে ‘রাতের জাতীয় কাব্য’ বা ‘রাঢ়ের মহাকাব্য’ কে বলেছেন?
উঃ ড: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
৫১. ঘনরাম চক্রবর্তীর লেখা কতগুলি বৈষ্ণবপদ কোথায় সঙ্কলিত হয়েছে?
উঃ ঘনরাম চক্রবর্তীর লেখা ১৫টি বৈষ্ণবপদ ‘পদকল্পতরু’তে সঙ্কলিত হয়েছে।
৫২. ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনার প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?
উঃ এই কাব্য রচনার প্রধান উদ্দেশ্য দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার লৌকিক অনার্য দেবতা ধর্মঠাকুরের
মাহাত্ম্য প্রচার।
৫৩. “চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ঐশ্বর্য যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি যেমন মুকুন্দরাম, ঘনরামও তেমনি
ধর্মমঙ্গল কাব্যের ঐশ্বর্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি।” – মন্তব্যটি কার?
উঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য
৫৪. রামদাস আদক জাতিতে কি ছিলেন?
উঃ কৈবর্ত
৫৫. ধর্মমঙ্গল কাব্যে কোন্ যুগের ইতিহাস বর্ণিত?
উঃ পাল যুগের
৫৬. ঘনরামের কাব্যের ত্রুটি কোথায়?
উঃ অলৌকিক অবাস্তব ঘটনা। শাস্ত্র নির্ভরতা
৫৭. লাউসেনকে Semi mithycal hero কে বলেছেন?
উঃ ও ‘ম্যালি সাহেব।
৫৮. “ঘনরামের কাব্যের প্রধান গুণ স্বচ্ছন্দতা ও গ্রাম্যতাহীনতা” কোন্ সমালোচকের অভিমত?
উঃ সুকুমার সেন
৫৯. মহামদ কোন রোগে আক্রান্ত হয়?
উঃ কুষ্ঠ
৬০. অষ্টাদশ শতাব্দীর কজন ধর্মমঙ্গল অপ্রধান কবির নাম বল?
উঃ গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, রামাকান্ত, রামনারায়ণ, নরসিংহ বসু
৬১. সংস্কৃত ভাষার কাব্য ‘সূর্যশতক’ কে রচনা করেন?
উঃ ময়ূরভট্ট
৬২. ‘ধর্মমঙ্গল’ এ কোন নদীর কথা আছে?
উঃ অজয়
৬৩. যদুনাথ পন্ডিতের কাব্য কে কোথা থেকে উদ্ধার করেন? আর কি নাম দিয়ে কোথা থেকে প্রকাশ
করেন?
উঃ ড. পঞ্চানন মন্ডল, এক তাঁতির বাড়ি থেকে, ‘ধর্মপুরাণ’ নামে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত
হয়।
৬৪. ময়ূরভট্টে বন্দিব আদ্যকবি – কে লিখেছেন?
উঃ ঘনরাম চক্রবর্তী
৬৫. কর্ণসেনের সাথে লাউসেনের সম্পর্ক কি?
উঃ পিতা ও পুত্র
৬৬. ধর্মঠাকুরের পূজার উপকরণ কী?
উঃ মদের পুস্কার্ণ দিল পিটারে জাঙ্গাল
৬৭. রাজা হরিশ্চন্দ্রের স্ত্রীর নাম কী?
উঃ মদনা
৬৮. ধর্মঠাকুরকে কে ‘প্রাগার্য সূর্য দেবতা’ বলেছেন
উঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য
৬৯. ময়ূরভট্ট রচিত ‘শ্রীধর্মপুরাণ’ কার সম্পাদনায় কোথা থেকে প্রকাশিত হয়?
উঃ বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে
৭০. ধর্মঠাকুরকে কে প্রথম ‘বৌদ্ধ দেবতা’ বলেছেন
উঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
৭১. এই কাব্যের মধ্যে কোন কবির পুঁথি প্রাচীন?
উঃ প্রাপ্ত পুথির মধ্যে রূপরাম চক্রবর্তীর পুঁথি প্রাচীন।
৭২. ধর্মমঙ্গলের প্রথম পর্বের গ্রন্থগুলিতে পাঁচ জন ধর্মদ্বারপালের নাম পাওয়া যায়,
এঁদের নাম কী কী?
উঃ সেতাই পন্ডিত, নীলাই পন্ডিত, কংসাই পন্ডিত, রামাই পন্ডিত ও গোঁসাই পন্ডিত
৭৩. ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্রগুলোর নাম কী কী?
উঃ এ কাব্যের মূল চরিত্রগুলো হলো – হরিশ্চন্দ্র, মদনা, লুইচন্দ্র, কর্ণসেন, গৌড়েশ্বর,
লাউসেন।
৭৪. নরসিংহ বসুর কাব্যের উপর কাজ করে কে কী ডিগ্রী পান?
উঃ সুকুমার মাইতি
৭৫. ঘনরাম তাঁর কাব্য সূচনায় কোন কোন দেব-দেবীর বন্দনা করেছেন?
উঃ গণেশ, সরস্বতী, ধর্মদেবতার।
আরো পড়ুন
৭৬. ঘনরাম তাঁর কাব্যের নাম ‘অনাদিমঙ্গল’ ছাড়া আর কি নাম ব্যবহার করেছেন?
উঃ ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘মধুরভারতী’
৭৭. ঘনরাম তাঁর কাব্য সূচনায় কোন কোন দেব-দেবীর বন্দনা করেছেন?
উঃ আখড়া পালায়
৭৮. শ্যাম পন্ডিতের রচনার নাম কি? তিনি কাদের পুরহিত ছিলেন?
উঃ নিরঞ্জনমঙ্গল। ডোম
৭৯. বিশ্বভারতী থেকে কে কি নামে ধর্মসংক্রান্ত পুঁথি প্রকাশ করেন?
উঃ পঞ্চানন মন্ডল। অনাদ্যের পুঁথি
৮০. রামাই পন্ডিত এর শূণ্যপূরাণ কে আবিস্কার করেন? নিরঞ্জনের উষ্মা কী? ময়ূর ভট্টের
শ্রীধর্মপুরাণ কে জাল বলে প্রমাণ করেন?
উঃ নগেন্দ্রনাথ বসু। কতকগুলি অদ্ভুত ছড়া। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি।
৮১. “অনিলপুরাণ” নামে ধর্মমঙ্গলকাব্য কে রচনা করেন?
উঃ সহদেব চক্রবর্তী
৮২. ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক কে?
উঃ লাউসন
৮৩. ঘনরাম চক্রবর্তী রচিত অনাদিমঙ্গলের রচনাকাল জ্ঞাপক শ্লোকটির কি?
উঃ শক লিখে রাম গুন রস সুধাকর
৮৪. ধর্মমঙ্গল কাব্যের পূর্ণাঙ্গ পুঁথি কে রচনা করেন?
উঃ রূপরাম চক্রবর্তী
৮৫. ময়ূরভট্ট ধর্মমঙ্গল ছাড়া আর কোন গ্রন্থ রচনা করেন?
উঃ সূর্যশতক
৮৬. ধর্মমঙ্গল কে কোন অঞ্চলের কাব্য বলা হয়?
উঃ রাঢ়
৮৭. ধর্ম ঠাকুর কোন অঞ্চলে মোহন রায় নামে পরিচিত?
উঃ বরুন গ্রাম
৮৮. ধর্মমঙ্গল কাব্য কোন শ্রেণীর মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল
উঃ মুসলমান কৃষিজীবী সম্প্রদায়
৮৯. সীতারাম কোন দেবতার দ্বারা আদিষ্ট হয়ে কাব্য রচনা করেন?
উঃ গজলক্ষী
৯০. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যের ছন্দ কি?
উঃ মিশ্রকলাবৃও
৯১. ধর্ম ঠাকুরের পূজারীদের উপাধি কী?
উঃ পণ্ডিত
৯২. লাউসেনের কাহিনীতে মহিলা কবি কে ছিলেন?
উঃ কলিঙ্গা ও কানাড়া
৯৩. লাউসেনের প্রথম স্ত্রীর নাম কী?
উঃ কানাড়া
৯৪. ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্যের আর কী কী নাম পাওয়া যায়?
উঃ মধুরভারতী, শ্রীধরমসঙীত, অনাদিমঙ্গল
৯৫. ‘তিন বনে চারি যুগে বেদে যত রয় /শাকে সনে জড় হৈলে কত শক হয় / রসের উপরে রস তাহে
রস দেহ / এই শকে গীত হৈল লেখা কইরা লেহ’―কার গ্রন্থ রচনাকাল সম্পর্কিত
শ্লোক?
উঃ রূপরাম চক্রবর্তী
৯৬. ধর্মঠাকুরের পূজা কোথায় প্রচলিত ছিল?
উঃ সাধারণত, ডোম-সমাজেই এই দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল, এখনো আছে। ধর্মঠাকুর নিরঞ্জন নিরাকার
আদ্য দেবতা। ধর্মঠাকুরের উদ্ভবের মূলে কেউ বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিরতের, কেউ বা বৈদিক সূর্যদেবতার,
কেউ বা আর্যের প্রভাব অনুসন্ধান করেন।
৯৭. ধর্মমঙ্গল কাব্যের দুটি ঐতিহাসিক চরিত্রের নাম লেখ?
উঃ ধর্মপাল ও ইছাই ঘোষ।
৯৮. ঘনরাম চক্রবর্তী কার কাছ থেকে কবিরত্ন উপাধি পান?
উঃ কবিগুরু শ্রীরাম দাসের কাছ থেকে।
৯৯. দলু রায় কোন অঞ্চলের নাম?
উঃ শ্যামবাজার
১০০) লাউসেনের স্বর্গীয় পরিচয় কী?
উঃ কশ্যম মুনির পুত্র
অন্নদামঙ্গল
প্রথমেই বলেনি যে কারোর পোস্ট ভবিষ্যতেও দেখতে চাইলে অবশ্যই তাতে লাইক কমেন্ট শেয়ার
ইত্যাদি করবেন। নইলে সেই ব্যক্তির পোস্ট আপনা থেকেই আপনার কাছে পৌঁছোনো কমে যাবে। এটা
মনগড়া কথা নয়, এটা ফেসবুক পলেসি।
এ নিয়ে প্রথম পর্যায়ের পোস্টের পর এটা আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
** অন্নদামঙ্গল
কী?
দেবী অন্নদা বা অন্নপূর্ণা কে নিয়ে লেখা মঙ্গলপাঁচালিই হল অন্নদামঙ্গল।
আদি কবি:- এই ধারায় আদি কবি ভারতচন্দ্র।
অন্যান্য কবি
দুর্গাদাস_মুখোপাধ্যায়
গ্রন্থঃ গঙ্গামঙ্গল
পৃথ্বীচন্দ্র
গ্রন্থঃ গৌরীমঙ্গল
রামচন্দ্র_মুখোপাধ্যায়
গ্রন্থঃ দুর্গামঙ্গল
ভবানীপ্রসাদ_রায়
গ্রন্থঃ দুর্গামঙ্গল
প্রমুখ।
ভারতচন্দ্র
জন্মস্থান- হাওড়ার ভুরশুট পরগণার পেঁড়ো গ্রাম।
জীবনকাল - আনুমানিক ১৭০৫ খ্রি- ১৭৬০ খ্রি
পদবীঃ মুখোপাধ্যায়
আশ্রয়দাতাঃ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
ফার্সি_শিক্ষকঃ রামচন্দ্র মুনশি
হাজতবাস
কবিকে জমিসংক্রান্ত প্রতিহিংসায় বর্ধমানরাজ জেলবন্দী করেন। পরে তিনি ছাড়া পান। বলা
হয়ে থাকে এই অত্যাচারের প্রতিশোধ তিনি তোলেন বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ধমান রাজের নাককেটে।
যদিও এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে।
বহুভাষাবিদ_কবি
ভারতচন্দ্র ছোট বেলাতে প্রথমে সংস্কৃত শেখেন কিন্তু ততদিনে সেইভাষা দিয়ে নেহাতই কিছু
ব্রাহ্মণ করেকম্মে খেত, তাতে ভারতচন্দ্রর আশ মেটার কথা নয়।তাছাড়া তার পরিবার পরিজন
সবাই এ নিয়ে ব্যঙ্গ করতে শুরু করে। তারপর তিনি তৎকালীন রাজভাষা ফারসি শেখেন, তাতে চাকরি
পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা তখন। একইসঙ্গে বাংলা ভাষায় তাঁর অগাধ জ্ঞান। (বাংলাকে তখন নাক
উঁচু পণ্ডিতেরা কেবলই 'ভাষা' বলতেন)। তার সঙ্গে হিন্দি এবং আরবিও তাঁর করায়ত্ত ছিল।
যার পরিচয় তাঁর কাব্যে স্পষ্ট।
যাবনী_মিশাল
এই শব্দবন্ধটি ভারতচন্দ্রের হাত ধরেই পরবর্তীতে পরিচিত। বার কতক তাঁর কাব্যমধ্যে তিনি
এটি ব্যবহার করেন।
যাবনী মিশাল কথার অর্থ হল আরবি ও ফারসি মিশ্রিত ভাষা।
ভবঘুরে_জীবন
কবির পরিবার বর্ধমান রাজের অত্যাচারে নিঃস্ব হয়।কবি কম বয়সেই বিয়ে করেন কিন্তু অচিরেই
সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আবার সন্যাস ত্যাগও করেন ক'বছরেই। এরইমধ্যে তিনি ভূ-ভারত ঘুরে
দেখেন। ধর্ম ব্যবসাকেও খুব কাছ থেকে পরখ করেন। তাঁর কাব্যে এসবের পরিচয় বর্তমান।
পতিনিন্দা তাঁর কাব্যে একটি চমৎকার অধ্যায় আছে(সব মঙ্গলকাব্যেই থাকে) যেখানে প্রত্যেক
স্ত্রী তাঁর পতিনিন্দা করছে। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম হল তাঁর স্ত্রীর মুখ দিয়ে তিনি
নিজেরও নিন্দা করিয়েছেন, যদিও তা সমধুর। বাকি পতিনিন্দার বিবরণে কিন্তু তৎকালীন পুরুষতন্ত্র
দাঁতনখ বেড় করে আছে। শোনা যায় কৃষ্ণচন্দ্র একবার ভারতচন্দ্রকে ঠকাবার জন্যে সুন্দরী
মেয়ে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু কবিকে পটাতে পারেননি সেই সুন্দরী। কারণ তিনি তাঁর একমাত্র
স্ত্রীতেই ছিলেন পরিপূর্ণ। অথচ সেই সময়ে মেয়েদের নিয়ে চিরকালের মতোন ছিনিমিনি খেলা
হত।
গ্রন্থঃ
১.সত্যপীরের পাঁচালী< এটি একটি সর্বধর্ম সমন্বয় প্রয়াসী কাব্য।
২.রসমঞ্জরী>প্রকীর্ণ কবিতা।
৩.নাগাষ্টক < গঙ্গামঙ্গল ধর্মী গ্রন্থ।
৪.গঙ্গাষ্টক < গঙ্গাকে নিয়ে লেখা।
৫.চণ্ডীনাটক> অসমাপ্ত নাটক।
৬.অন্নদামঙ্গল। এর তিনটি ভাগ যথাঃ
ক।অন্নদামঙ্গল - বিশুদ্ধ অন্নদামঙ্গল এটিই।
খ।কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর- এটি আসলে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনী।(এই নিয়ে
পরবর্তী পোস্ট হবে)
গ।অন্নপূর্ণা মঙ্গল বা মানসিংহ- এর মধ্যে কিছুটা ইতিহাসের ছোঁয়া আছে। আছে ভারতপতি জাহাঙ্গীরকে
দিয়ে দেবীর পূজা করানো, একইসঙ্গে ইসলামের তত্ত্বগত ভালো দিক গুলিরও প্রশংসা।
প্রথম গ্রন্থ
সত্যপীরের পাঁচালী
শেষ গ্রন্থ
চণ্ডী নাটক
জীবনদর্শন
বাংলা কাব্যধারায় ব্রাহ্মণ কর্তৃক বৌদ্ধদের অত্যাচারের নমুণা পাওয়া যায় আবার তারাও
এর তীব্র বিরোধিতা করেন। বৈষ্ণবরা মনসামঙ্গলের কবিদের গালি দিতে ছাড়েননা, তেমনি তারাও
ছাড়েননা। বৈষ্ণবেরা শাক্তদের, শাক্তরা বৈষ্ণবদের যা নয় তা ঝাড়েন। আবার এক ধর্মের সঙ্গে
অন্য ধর্মেরও একইরকম সাপেনেউলে সম্পর্ক। এইসব কলহ ভারতচন্দ্র চাক্ষুষ করেছেন। সঙ্গে
সেই বাবুসংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে এমন সমাজ যেখানে মানুষ কেবলই ভোগবাদী। এগুলো সব তাঁর পরখ
করা। এসবের ফলেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সামগ্রিক ধর্মচর্চার বিরোধী, যদিও ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে
তাঁর আপত্তি ছিলনা। আর তা করতে গিয়েই তিনি দেবতাদের পরিণত করেছেন ভাঁড়ে। আবার বিশুদ্ধ
যৌনতার কাব্যও লিখেছেন। তিনি একইসঙ্গে ধর্মসমন্বয়েরও স্বপ্ন দেখতেন, ইসলাম হিন্দু সবকে
মেলাতে চেয়েছিলেন এমনকি খ্রিস্টানকেও। ভালোবাসতেন বাংলা ভাষাকে।
ভারতচন্দ্র_মুকুন্দরাম
মধ্যযুগের কাব্যে কে শ্রেষ্ঠ এ নিয়ে বিরাট তর্ক।
যারা ভারতচন্দ্রকে শ্রেষ্ঠ বলেছেন< হরচন্দ্র দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ
বিশী, প্রমথ চৌধুরী।
অপরদিকে #ভারতচন্দ্র বিরোধী গোষ্ঠীতে বর্তমানঃ
রাজনারায়ণ বসু, রমেশচন্দ্র দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, অক্ষয়কুমার সরকার মায় রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত।
এঁরা ভারতচন্দ্রের ধর্ম নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গ এবং যৌনতাকে নিয়ে কাব্যপ্রয়াসের যথেষ্ট অস্বস্তি
বোধ করতেন। যদিও রবি ঠাকুর চিত্রাঙ্গদা লেখেন এবং একইদায়ে দোষী পরিগণিত হন।
প্রথম সচিত্র প্রকাশ :
অন্নদামঙ্গল এর প্রথম সচিত্র সংস্করণ প্রকাশ করেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।
সন- ১৮১৬।
প্রামাণিক_সংস্করণ (প্রথম)
ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম_সমালোচক_ভারতচন্দ্রের লেবেদেফ।
বাংলায়_প্রথম_সমালোচক
কালীপ্রসাদ ঘোষ মতান্তরে রাধামোহন ঠাকুর
ইংরেজি_অনুবাদক
প্রথম - হালহেড।
প্রথম বাঙালি- কাশীপ্রসাদ ঘোষ
গদ্যানুবাদ- গৌরদাস বৈরাগী
রুশ_অনুবাদক (প্রথম)
হীরা_মালিনী
ভারতচন্দ্রের সেরা চরিত্র এটি। বঙ্কিমচন্দ্র নিজে ভারতচন্দ্রের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হলেও
এই চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
ছন্দ অলঙ্কার প্রবাদ :
তাঁর কাব্যে শতাধিক প্রবাদ ব্যবহৃত, আর কত যে প্রবচন...(এখানে উল্লেখ করার জায়গা নেই)
অপরদিকে ছন্দ ও অলঙ্কারের দিক দিয়ে তিনি সৈয়দ আলাওলের মতোন শিল্পী কবি। যদিও এসবের
মাত্রাছাড়া ব্যবহারও করেছেন কবি। অনুপ্রাস, শ্লেষ, বিরোধাভাস, ব্যাজস্তুতি এসব অলঙ্কার
সহজলভ্য তাঁর কাব্যে। তিনি সংস্কৃত ও আরবি-ফারসিতে প্রাজ্ঞ হওয়ায় এসবে শিল্পসফল।
👉 কড়িতে বাঘের দুধ মেলে।
👉 জন্মভূমি জননী স্বর্গের গরিয়সী।
👉 বড়র পিরীতি বালির বাঁধ।
👉 মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন।
👉 নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়।
ভারতচন্দ্র কে নিয়ে লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ :
১.কবিবর ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত - ঈশ্বর গুপ্ত
২.কবি ভারতচন্দ্র- শঙ্করীপ্রসাদ বসু
৩.ভারতচন্দ্র- মদনমোহন গোস্বামী
৪।অমাবস্যার গান- নারায়ণ গঙ্গোঃ
৫.মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্র- জিতেন্দ্রলাল বসু
৬.কবিজীবনী- ভবতোষ দত্ত
৭.ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ - শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য
এছাড়া প্রচুর প্রবন্ধ বাংলায় ও ইংরেজিতে।
পূর্বসূরির প্রভাব :
মুকুন্দরাম,আলাওল, রামেশ্বর এনাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন ভারতচন্দ্র।
গুরুত্ব
১.তাঁর রচনা নূতন মঙ্গল
২. মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ
৩.ধর্মীয় আচার সর্বস্বতার চাঁচাছোলা বিরোধিতা
৪.বহু ভাষার ব্যবহার, একইসঙ্গে খাঁটি বাংলায় শক্তিপ্রদর্শন।
৫.বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে নিয়ে খড়্গহস্ত হলেও ভারতচন্দ্রের চনমনে ভাষাব্যবহার দ্বারা প্রভাবিত।
৬.মধুকবি তাঁকে অস্বীকার করেননি বরং জানিয়ে দেন ভারতচন্দ্রকে দাঁড় করিয়েই তাঁর অমিত্রাক্ষরযাত্রা,এবং
তাতে তিনি সফলও।
৭.ঈশ্বরচন্দ্র কলেজে ভারতচন্দ্রের খেউর পড়াতে খুব অস্বচ্ছন্দ বোধ করতেন কিন্তু তাঁর
গদ্যশৈলী গড়ে উঠেছে ভারতচন্দ্রেরই ভাষাশৈলীকে অনুসরণ করে।
৮.বাঙালির শ্রেষ্ঠকবি হিসাবে একসময়ে তাঁর দাপট ছিল।
প্রশ্নোত্তরে অন্নদামঙ্গল :
👉 দেবী অন্নদার বন্দনা আছে – অন্নদামঙ্গল কাব্যে।
👉 অন্নদামঙ্গল ধারার প্রধান কবি – ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর।
👉 বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি – ভারতচন্দ্র।
👉 ভারচন্দ্রের উপাধি – রায়গুণাকর।
👉 মঙ্গলযুগের শেষ কবি – ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর।
👉 অন্নদামঙ্গল কাব্য বিভক্ত – তিন ভাগে।
👉 অন্নদামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা – ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর।
👉 অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রধান চরিত্র – ঈশ্বরী পাটনী, হীরামালিনী।
👉 ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ – ঈশ্বরী পাটনী, অন্নদামঙ্গল।
আরো কিছু জেনে নিইঃ-
১।ভারতচন্দ্রের দেবী অন্নদার
পরিচয় দাও।
উঃ- দেবী অন্যদা এখানে সরলা, স্নেহময়ি মাতা। কাশীতে যার অধিষ্ঠান। হরিহরের গৃহের নিত্য
কলহে অতিষ্ট হয়ে শান্তিপ্রিয় দেবী গেছে ভবানন্দ মজুমদারের বাড়ি।
২। ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেবী অন্নদা তার দৈবী মহিমা হারিয়ে সাধারণ গৃহস্থ ঘরের কুলবধুতে
পরিণত হয়েছে।
৩। কবি ভারতচন্দ্রের আবির্ভাব ও তিরোধান কাল লেখ।
উঃ- 1713—1760
ঈশ্বর গুপ্তের মতে ১৭১৩ খ্রী--আর মৃত্যু ১৭৬০ খ্রী:।:। অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের
মতে ১৭০৫-১৭১১ খ্রী: মধ্যে।
৪।- কোন সাহিত্যিক তার কোন বিশেষ প্রবন্ধে ভারতচন্দ্রকে ""ফাদার অফ মর্ডান
বেংগলি"" বলেছেন??
উঃ- বংকিমচন্দ্র তার "BENGALI LITERATURE" প্রবন্ধ
৫। ভারতচন্দ্র তার কাব্যে কি কি ছন্দের ব্যবহার করেছেন??
উঃ- প্রধান ছন্দ পয়ার ত্রিপদী
৬। কোন কবির জীবনাবসানের সাথে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে?
উঃ - কবি ভারতচন্দ্রের জীবন অবসানের মাধ্যমে।
৭। ভারতচন্দ্রের জন্মস্থান কোথায়?
উ- হুগলীর ভুরশুট পরগনার পেড়ো গ্রাম।
৮। ভারতচন্দ্রের রচিত মঙ্গলকাব্যের নাম কি?
উঃ -অন্নদামঙ্গল কাব্য।
৯। ভারচন্দ্র কার সভাকবি ছিলেন?
উ- ভারতচন্দ্র ফরাসডাঙ্গার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মধস্থতায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের
সভাকবি হন।
১০। ভারতচন্দ্রকে কে রায়গুণাকর উপাধি দেন?
উঃ- কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
১১। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির নাম কি?
উঃ- ভারতচন্দ্র
১২। ভারতচন্দ্র কেন মুনিগোঁসাই নামে পরিচিত?
উঃ- বৈষ্ণব বেশবাশ ধারনের জন্য।
১৩। ভারত চন্দ্রের বার্ধক্যের বারানসী কোন জায়গা?
উঃ- মুলিজোড়
১৪। কে যুগসন্ধির কবি নামে পরিচিত?
উঃ- ভারতচন্দ্র
১৫। ভারতচন্দ্রের পিতা মাতার নাম কি?
উঃ- নরেন্দ্র রায় ও ভবানী দেবী।
১৬। ভারতচন্দ্র রচিত কয়েকটি কাব্যের নাম কি?
উঃ- ক) সত্যপীরের পাঁচালী (১৭৩৮)
খ) রসমঞ্জরী (১৭৪৯)
গ) নাগাষ্টক (১৭৫০)...
১৭। ভারতচন্দ্রের স্ত্রীর নাম কি?
উঃ- রাধা
১৮। ভারতচন্দ্রের পুত্রদের নাম কি কি?
উঃ- ৩ জন, পরীক্ষিত,রামতনু, ভগবান
১৯। ভারতচন্দ্র এই কাব্যে কি কি অলংকার ব্যাবহার করেছেন?
উঃ – অনুপ্রাস, যমক, ব্যতিরেক
২০। কাব্যটি রচনার জন্য কি কবি দেবির স্বপ্নাদেশ পান?
উঃ- না
২১। এই কাব্যে কবি কোন ভাষা ব্যবহার করেছেন
উঃ- সংস্কৃত, অসংস্কৃত, আরবি,ফারসি ইত্যাদি, এই মিশ্রভাষা ভঙ্গীকে কবি "যাবনী
মিশাল " বলেছেন।
এছাড়াও কবি তৎসম,তদ্ভব, দেশী শব্দ ব্যবহার করেছেন
২২। ভারতচন্দ্রের প্রথম রচনা কোনটি?
উঃ- সত্যপীরের পাঁচালী
২৩। কার নির্দেশে রচনা করেন?
উঃ- রাজা কৃষ্ণচন্দ্র
২৪। কৃষ্ণচন্দ্র কবিকে কত টাকা মাসিক বেতনে সভাকবি পদে নিযুক্ত করেন?
উঃ- মাসিক চল্লিশ টাকা
২৫। অন্নদামঙ্গল কতগুলো পালায় বিভক্ত?
উঃ- ৮ টি
২৬। “ভারতচন্দ্রের কাব্য ভাষার তাজমহল” কে বলেছেন
উঃ- দীনেশচন্দ্র সেন
২৭। অন্নদামঙ্গলে কতগুলি উপকাহিনী আছে?
২৮। কে ভারতচন্দ্রকে যুগসন্ধির কবি বলেছেন?
উঃ- ঈশ্বর গুপ্ত
২৯। অন্নদামঙ্গল কাব্যের নায়ক ও নায়িকা কারা?
ঊ- বিদ্যা ও সুন্দর
৩০। ভারতচন্দ্রকে কার সঙ্গে তুলনা করা হয়?
উঃ- টমাস হার্ডির সঙ্গে
দীনেশচন্দ্র সেন জয়দেবের সাথে তুলনা করেছেন।
৩১। ভারতচন্দ্রকে সাহিত্যের চরম কারু শিল্প কে বলেছেন?
উঃ- প্রমথ চৌধুরী
৩২। ভারতচন্দ্রের একটি নাটকের নাম কি
উঃ- চণ্ডীনাটক (১৭৫০-৬০)
৩৩। কাঠের সেঁউতি আমার হইল অষ্টাপদ – সেঁউতি ও অষ্টাপদ কি
উঃ- সেঁউতি – নৌকার জল সেঁচার পাত্র। অষ্টাপদ – সোনা
৩৪। ভারতচন্দ্র কোন বিষয়ের পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন?
উঃ- সংস্কৃত
৩৫।ভারতচন্দ্র ছাড়া সত্যপীরের পাঁচালি করেছেন কারা?
উঃ- শেখ ফৈজূল্লা, রামেশ্বর ভট্টাচার্য
৩৬। ভারতচন্দ্রকে কে "man of elegant genius'' কে বলেছেন?
৩৭। মধুসূদন দত্ত
৩৮। বিনাদোষে কার দ্বারা কবি কারারুদ্ধ হন?
উঃ- বর্ধমান রাজার
৩৯। দরবারী ভাষা কি?
উঃ- আরবি –ফারসি মিশ্রিত বাংলা ভাষা
৪০। এই কাব্যের কয়েকটি প্রবাদ বাক্য কি?
ক।নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়
খ।.সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।
গ। .হাভাতে যদ্যপি চায়,সাগর শুকায়ে যায়।
৪১। কবিবর ভারত চন্দ্র রায়গুনাকর জীবন বৃত্তান্ত "-গ্রন্থের লেখক কে?
উঃ- ঈশ্বর গুপ্ত .
৪২। অন্নপূর্ণা মঙ্গলের অপর নাম কি?
উঃ- শিবায়ণ
৪৩। বঙ্কিমচন্দ্র ভারতচন্দ্রের কোন কাব্যটিকে বাংলা সাহিত্যের সার্থক গীতিকাব্য বলেছেন?
উঃ- রসমঞ্জরী
৪৪ হরিহর কোন গ্রামে বাস করত?
উঃ- বড়গাছি
৪৫। অন্নদামঙ্গলের কোন অংশে মঙ্গল কাব্যের রীতি অনুসারী হয়নি?
উঃ- বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল
৪৬। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলকে 'কথার তাজমহল' কে বলেছেন?
উঃ- নলিনীনাথ চট্টোপাধ্যায়
৪৭। বিবিধ কবিতাবলির কয়েকটি কবিতার নাম লেখ।
উঃ- বৃন্দাবনীর উক্তি, বলী রাজার উক্তি, বসন্ত বর্ণনা,বর্ষা বন্দনা
৪৮। ব্যাসদেবের পিতার নাম কি?
উঃ- পরাশর
৪৯। ভারতচন্দ্রের "সত্যপীরের পাঁচালী কোন ছন্দে লেখা?
উঃ- চৌপদী
৫০। অন্নদামঙ্গলের কাব্যের গীতিরূপ কে দেন
উঃ- নীলমণি সমাদ্দার
৫১। ভারতচন্দ্রকে ফরাসী ভাষা শেখেন কার কাছ থেকে?
উঃ- রামচন্দ্র মুন্সী
৫২। বাংলা সাহিত্যের নাগরিক কবি কে?
উঃ- ভারতচন্দ্র
৫৩। বিদ্যা ও সুন্দরের পূর্ব পরিচয় কি?
উঃ- ভৈরব ও ভৈরবী, ণাম ছিল জগদানন্দ ও জগতবতী
৫৪। অন্নদামঙ্গল কাব্যের প্রথম গায়েন কে?
উঃ- নীলমণি সমাদ্দার
৫৫। "বিদ্যাসুন্দর খেলনা হলেও রাজার বিলাসভবনের পাঞ্চালিকা --সুবর্ণে গঠিত, সুগঠিত
এবং মনিমুক্তায় অলংকৃত "------- কে বলেছেন
উঃ- প্রমথ চৌধুরী “ বীরবলের হালখাতায়”
৫৬। বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় কবে অন্নদামঙ্গল প্রকাশিত হয়?
৫৭। "একা দেখি কূলবধু কে বট আপনি "--- কূলবধুটি কে? :
উঃ- দেবী অন্নপূর্ণা
৫৮। পদ্মিনী কে?
উঃ- হরিহোড়ের মা
৫৯। বিদ্যাসুন্দর কাব্যটির উৎস কি?
উঃ- বিলহণের “চৌরপঞ্চাশিকা”
৬০। বিদ্যাসুন্দর কাব্যটিকে কে 'রোমান্টিক স্যাটায়ার' বলেছেন?
৬১। . বিদ্যাসুন্দর এর ইংরেজি অনুবাদ কে করেন
উঃ- ১৮৯০, - গৌরদাস বৈরাগী
৬২।। অন্নদামঙ্গল গ্রন্থাকারে কে প্রকাশ করেন?
উঃ - গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য 1816
৬৩। মঙ্গলকাব্য ধারায় ভারতচন্দ্রের দেবী অন্নদার স্বাতন্ত্র্য কি?
উঃ- তিনি কোপনস্বভাবা নন।
৬৪। এই কাব্যের নায়ক কে?
৬৫। ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে ব্যাসদেব চরিত্রকে কীভাবে উপস্থাপিত করেছেন?
উঃ- বৈষ্ণববেশী ভাঁড় হিসেবে
৬৬। কবির মিস্র ভাষায় রচিত গ্রন্থের নাম কি?
৬৭। ভারতচন্দ্রের ধারায় কে কে আধুনিককালে কাব্য রচনা করেছেন?
৬৮। ভারতচন্দ্রের কোন কাব্যটি সংস্কৃতে রচিত?
উঃ—রসমঞ্জরী
৬৯।-অন্নদামঙ্গলের সচিত্র সংস্করণ প্রথম কে প্রকাশ করেন?
-উঃ- গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
৭০। )-ভারতচন্দ্রকে কৃস্নচন্দ্র কত টাকা ও কোন গ্রাম দান করেন?
উঃ- ১০০টাকা, মূলাজোড় গ্রাম
৭১। কোন কোন প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ অবলম্বনে বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসুন্দর কাহিনীর সুত্রপাত?...
উঃ- -বিলহনের চৌরপঞ্চাসিকা এবং বররুচির বিদ্যাসুন্দরম নাটক।...
৭২। কার বাড়িতে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের প্রথম অভিনয় হয়?
ঊ-। নবীন চন্দ্র বসুর বাড়ির থিয়েটার এ
কলিকামঙ্গল
👉 দেবী কালীর মহত্ম্য বর্ণনামূলক গ্রন্থ – কলিকামঙ্গল।
👉 কলিকামঙ্গল ধারার আদি কবি – কবি কঙ্ক।
👉 কলিকামঙ্গল নামক অভিহিত কাব্যধারাকে বলা হয় – বিদ্যাসুন্দর।
👉 বিদ্যাসুন্দর কাব্যের অন্যতম কবি – রামপদ সেন, সাবিরিদ সেন।
👉 কলিকামঙ্গলেরর বিশিষ্ট কবি – রামপ্রসাদ সেন।
👉 রামপ্রসাদের কাব্যগ্রন্থের নাম – কবিরঞ্জন।
অন্যান্য তথ্যঃ-
১। ভবানীমঙ্গল কার লেখা?
উঃ- দ্বিজ গঙ্গানারায়ণ
২। সারদামঙ্গল কার লেখা?
উঃ- দয়ারাম দাস
৩। সারদামঙ্গলের আদি কবি কে?
উঃ- নিত্যানন্দ চক্রবর্তী
৪। মানিকরাম গাঙ্গুলি কোন কাব্যের কবি উঃ- শীতলামঙ্গল
৫।দুর্গামঙ্গলের ২ জন কবির নাম লিখুন কাব্যসহ, কোন শতকের কবি?
উঃ- দ্বিজ কমললোচন – চণ্ডিকা বিজয়
ভবানিপ্রসাদ রায় –দুর্গামঙ্গল, সপ্তদশ শতক
৬।কৃষ্ণরাম রচিত কাব্যের নাম কি কি?
ক। রায়মঙ্গল
খ। ষষ্ঠষষ্ঠীমঙ্গল গ। শীতলামঙ্গল
ঘ। কমলামঙ্গল ঙ। কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর
৭। গৌরীমঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি কে
উঃ- পৃথ্বীরাজ আচার্য শিবচরণ
৮। দুর্গামঙ্গল কি অনুসরণে লিখিত?
উঃ-মাকর্ন্ডেয় পূরানের দেবী চন্ডীর কাহিনি নিয়ে রচিত।
৯। মঙ্গল কাব্যের কোন কবি জন্মান্ধ?
উঃ ভবানীপ্রসাদ রায়
১০। বাসুলীমঙ্গল কার লেখা?
উঃ- দ্বিজ মুকুন্দ
১১। সূর্যমঙ্গলের কয়েকজন কবির ও কাব্য নাম লিখুন
উঃ- রামজীবন - আদিত্যচরিত। মালাধর বসু- অষ্টলোকপাল কথা, এছাড়া
দ্বিজ কালিদাস - সূর্যের পাঁচালি
১২। দক্ষিণ রায় কিসের দেবতা? এই নামের কারন কি?
উঃ- বাঘের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার দেবতা। এই দেবতার বাহন ব্যঘ্র। আর ইনি পূজিত
দক্ষিন বঙ্গে। তাই এমন নাম।
১৩। কৃষ্ণজীবনের কাব্য নাম কি?
উঃ- অভয়ামঙ্গল বা অম্বিকামঙ্গল
১৪। তীর্থমঙ্গল কার লেখা?
উঃ- বিজয়রাম সেন
১৫।অকিঞ্চন চক্রবর্তীর কাব্যের নাম কি?
উঃ- গঙ্গামঙ্গল। এছাড়া চণ্ডীমঙ্গল।
১৭। কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল কখন রচিত?
১৮। উঃ- ১৬৬৪ খ্রিঃ
১৯। ষষ্ঠী কীসের দেবতা?
উঃ- শিশুর রক্ষক
২০। ক। দ্বিজ শ্রীধরের কাব্যটি কে আবিষ্কার করেন?
উঃ- মুন্সি আব্দুল করিম
খ। কত খ্রিষ্টাব্দে রচিত?
উঃ- ১৫৩২ খ্রী
২১। সুন্দরবন অঞ্চলের অপ্রধান মঙ্গলকাব্য কোনটি?
উঃ- রায়মঙ্গল
২২। রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্র ছাড়া চারজন বিদ্যাসুন্দরের কবির নাম বলুন?
উঃ- ক। সাবিরিদ খা, খ। কৃষ্ণরাম দাস, গ। কঙ্ক,
ঘ। শ্রীধর
২৩। বাঘের ও কুমিরের দেবতা কে কে?
উঃ- বাঘের দেবতা - দক্ষিন রায়। এবং কুমিরের দেবতা কালু রায়
সত্যপীর আসলে কোন ধরণের দেবতা ২৪।
উঃ- মিশ্রদেবতা
২৫। ক। চণ্ডিকা বিজয় কার লেখা?
উঃ- দ্বিজ কমললোচন
খ। কোথা থেকে কত খ্রিষ্টাব্দে কার সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়?
উঃ – ১৩১৬ বঙ্গাব্দে রংপুর সাহিত্য পরিষদ থেকে পঞ্চানন সরকারের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত
হয়?
গ। কাহিনীর বিষয় কি অবলম্বনে রচিত?
উঃ- মার্কন্ডেয় পুরাণের দুর্গাসপ্তসতী
২৬। ক। সারদামঙ্গলের পুঁথি কে কোথা থেকে কত খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন?
উঃ- মুক্তিরাম সেন, ১৩২৪ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে, রচনা- ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দে
খ। সারদামঙ্গল কত খণ্ডে বিভক্ত?
উঃ- ২ টি
২৭। সারদামঙ্গলের আর একটি নাম কি?
উঃ- সারদাচরিত।
উঃ- বিদ্যা ও সুন্দর।
২৯। সুন্দর কোথাকার রাজকুমার এবং কোন দেবীর ভক্ত ছিলেন?
উঃ- কাঞ্চীর। কালিকার।
৩০। বিদ্যা কোথাকার রাজকুমারী ছিলেন?
উঃ- বর্ধমানের
৩১। কৃষ্ণরামের সর্বশেষ কাব্য কোনটি?
উঃ- কমলামঙ্গল।
৩২। চণ্ডিকাবিজয় কত অধ্যায়ে বিভক্ত?
উঃ- ১৪৬ টি
৩৩। ক। কৃষ্ণরামের রায়মঙ্গল কি জাতীয় রচনা?
উঃ- অপ্রধান মঙ্গলকাব্য
খ। -কাব্যটি কত খ্রিষ্টাব্দে সম্পন্ন হয়?
উঃ- ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে
গ। -এতে দেবতার নাম কি?
উঃ- দক্ষিণ রায়, মুসলিম প্রধান অঞ্চলে বড় খাঁ গাজি, উত্তরবঙ্গে সোনা রায়
৪। এতে কটি আখ্যান?
উঃ- ২ টি
৩৪। মানিকপীর কীসের দেবতা?
উঃ- পশুরক্ষার
৩৫। ক। কৃষ্ণরামের কত নম্বর কাব্য ষষ্ঠীমঙ্গল?
উঃ- ৩ নম্বর কাব্য
খ। -রচনাকাল কত?
উঃ- ১৬৭৯-৮০ খ্রিষ্টাব্দ
৩৬। গাজী কালু ও চম্পাবতী এ দুটি কাব্যের রচয়িতা কে
উঃ- শেখ খোদা বখশ
৩৭। রায়মঙ্গল কত সালে রচিত?
উঃ- 1686
৩৮। -কৃষ্ণরামের বাড়ি কোথায় ছিল?
উঃ- -নিমিতা
খ। পিতার নাম কি? .
গ। . ভগবতী দাস
ঘ। জাতি কি?-
উঃ- . কায়স্থ
ঙ কত বছর বয়সে তিনি কালিকামঙ্গল রচনা করেন?
উঃ- ২০ বছর
চ। তখন বাংলার সুবাদার কে ছিলেন?
৫। শায়েস্তা খাঁ
ছ। তিনি কটি কাব্য রচনা করেন ও কি কি?
কাব্য ৫ টি।
১. কালিকামঙ্গল
২। রায়মঙ্গল
৩। ষষ্ঠীমঙ্গল
৪। শীতলা মঙ্গল
৫। কমলামঙ্গল
৩৯। গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী কার লেখা?
উঃ- দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
৪০। মহেশবানী কি?
উঃ- বিদ্যাপতির লেখা হরপার্বতী বিষয়ক পদ
৪১। শিবমঙ্গল কার রচনা? এটি কয়টি পালায় বিভক্ত?
উঃ- রামকৃষ্ণ রায়, ২৬ টি
৪২। লক্ষ্মীমঙ্গল কার রচনা?
উঃ- শিবানন্দ কর
৪৩। পঞ্চাননমঙ্গল কার রচনা?
উঃ- দ্বিজ রঘুনন্দন
৪৪। ক। মঙ্গলচণ্ডীর পাঞ্চালিকার রচয়িতা কে?
উঃ- ভবানীশঙ্কর দাস
খ। কাব্যের পুঁথি কে সংগ্রহ করেন?
উঃ- রামচন্দ্র দত্ত
গ। কোথা থেকে প্রকাশ করেন? কত সালে?
উঃ- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে।
রামায়ণ
রামায়ণ
একটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য।হিন্দুবিশ্বাস অনুযায়ী, ঋষিবাল্মীকি রামায়ণের রচয়িতা।
এই গ্রন্থটি হিন্দুশাস্ত্রের স্মৃতিবর্গের অন্তর্গত।
রামায়ণ ও মহাভারত ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্য। এই কাব্যে বিভিন্ন সম্পর্কের পারস্পরিক
কর্তব্য বর্ণনার পাশাপাশি আদর্শ ভৃত্য, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ স্ত্রী ও আদর্শ রাজার চরিত্র
চিত্রণের মাধ্যমে মানবসমাজের আদর্শ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।রামায়ণ নামটি রাম ও অয়ন শব্দদুটি
নিয়ে গঠিত একটি তৎপুরুষ সমাসবদ্ধ পদ; যার আক্ষরিক অর্থরামের যাত্রা।
রামায়ণ ৭টি কাণ্ড (পর্ব) ও ৫০০টি সর্গেবিভক্ত ২৪,০০০শ্লোকেরসমষ্টি। এই কাব্যের মূল
উপজীব্য হল বিষ্ণুর অবতার রামের জীবন কাহিনি। বিষয়গতভাবে, রামায়ণ-উপাখ্যানে বর্ণিত
হয়েছে মানব অস্তিত্বের নানান দিক এবং প্রাচীন ভারতেরধর্মচেতনা। রামায়ণের শ্লোকগুলি
৩২-অক্ষরযুক্ত অনুষ্টুপছন্দে রচিত। পরবর্তীকালের সংস্কৃত কাব্য এবং ভারতীয় জীবন ও
সংস্কৃতিতে এই কাব্যের প্রভাব অপরিসীম।মহাভারতমহাকাব্যের মতোই রামায়ণও একটি কাহিনিমাত্র
নয়: হিন্দু ঋষিদের শিক্ষা দার্শনিক ও ভক্তি উপাদান সহ আখ্যানমূলক উপমার মাধ্যমে উপস্থাপিত
হয়েছে এই মহাকাব্যে।ভারতের সংস্কৃতি চেতনার মৌলিক উপাদানগুলিই প্রতিফলিত হয়েছে রাম,
সীতা, লক্ষ্মণ,ভরত, হনুমান ও রাবণ চরিত্রগুলির মধ্যে।হিন্দুধর্মের বাইরে ও বহির্ভারতেও
রামায়ণের কয়েকটি পাঠান্তর প্রচলিত রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখনীয় বৌদ্ধ রামায়ণ
দশরথ জাতক (জাতক সংখ্যা৬৪১) ওজৈনরামায়ণ এবং রামায়ণেরথাই,লাও,ব্রহ্মদেশীয়ওমালয়সংস্করণ।পাঠজোড়-বাংলা
মন্দির বা কেষ্টরায় মন্দিরের রামায়ণ মোটিফ (১৬৫৫ খ্রি.), বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া জেলা,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, ভারতের
আদিকবিবাল্মীকিরামায়ণ রচনা করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এইব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই
যে রামের সমসাময়িক তথাএই মহাকাব্যের অন্যতম চরিত্র ঋষি বাল্মীকি স্বয়ং এই মহাকাব্য
রচনা করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের মূল পাঠটিবাল্মীকি রামায়ণনামে পরিচিত।
এই গ্রন্থের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস
অনুযায়ী, রামায়ণ-উপাখ্যানের পটভূমিত্রেতাযুগনামে পরিচিত পৌরাণিক সময়কাল। বর্তমানে
সুলভ বাল্মীকি রামায়ণের সংস্করণটি মোটামুটি ৫০,০০০ পঙক্তি সম্বলিত। কয়েক হাজার আংশিক
ও সম্পূর্ণ পুথিতে এই পাঠটি বর্তমানে সংরক্ষিত। এই পুথিগুলি মধ্যে সর্বপ্রাচীন পুথিটিখ্রিষ্টীয়
একাদশ শতাব্দীতে লিখিত হয়। মূল রামায়ণের একাধিক আঞ্চলিক পাঠান্তর, সংস্করণ ওউপসংস্করণ
বিদ্যমান। পুথিবিশারদ রবার্ট পি. গোল্ডম্যান এই সংস্করণগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন।
যথা: (ক) উত্তর ভারতীয় ও (খ) দক্ষিণ ভারতীয়। এই সংস্করণগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যতামিল
ভাষায়কম্বনকর্তৃক রচিতরামাবতারম্(খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী),বাংলা ভাষায়কৃত্তিবাস ওঝাকর্তৃক রচিতশ্রীরামপাঁচালীবাকৃত্তিবাসী রামায়ণ(খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী) এবংহিন্দি ভাষারঅবধি উপভাষায়তুলসীদাস
গোস্বামীকর্তৃক রচিতরামচরিতমানস(খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী)। রামায়ণ বিশেষজ্ঞ তথাইংরেজিতেরামায়ণের
পদ্যানুবাদকরমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন,"মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও বহু শতাব্দীর
ফসল। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই কাব্যের মূল আখ্যান ভাগটি একক ব্যক্তির মস্তিস্কপ্রসূত।"
অবশ্য বাল্মীকি রামায়ণের প্রথম ও শেষ কাণ্ডদুটি মূল রচয়িতা কর্তৃক রচিত কিনা সেই
বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। রঘুনাথন মনে করেন, এই দুই কাণ্ডের কয়েকটি
প্রক্ষিপ্তাংশ বর্তমানে মূল রামায়ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হলেও, গ্রন্থের অন্যান্য
অংশের সঙ্গে এই অংশগুলির শৈলীগত পার্থক্য এবং আখ্যানগত স্ববিরোধপরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
রচনাকালবাল্মীকি রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। বিভিন্ন
সাংস্কৃতিক প্রমাণ (যেমন মহাভারতে সতীদাহ প্রথারউল্লেখ থাকলেও রামায়ণের মূল পাঠে তা
নেই) থেকে অনুমিত হয় এই গ্রন্থ মহাভারতের পূর্বে রচিত হয়েছিল। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী,হিন্দু কালপঞ্জিতেউল্লিখিত যুগপর্যায়ের দ্বিতীয় যুগত্রেতায়এই মহাকাব্য
রচিত হয়। কথিত আছে, ত্রেতা যুগেই ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা দশরথের পুত্র রামের জন্ম হয়।
তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও রামায়ণকে প্রাচীনতর গ্রন্থ মনে করা হয়। রামায়ণে উল্লিখিত
কয়েকটি চরিত্রনাম (যথা: রাম, সীতা, দশরথ,জনক, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র) বৈদিক সাহিত্যের
উল্লেখযোগ্য অংশব্রাহ্মণ-এও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি বাল্মীকি রামায়ণ অপেক্ষাও প্রাচীন।
তবে প্রাপ্ত বৈদিক কাব্যসাহিত্যে কোথাও বাল্মীকির
রামায়ণের অনুরূপ কোনো উপাখ্যানের সন্ধান পাওয়া যায় না। আধুনিক গবেষকগণের মতে,রামায়ণের
অন্যতম প্রধান চরিত্র ব্রহ্মাওবিষ্ণু(আদিকাণ্ডঅনুসারে রাম যাঁর অবতার)
বৈদিক দেবতা ছিলেন না। খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের শেষভাগে'পৌরাণিক' যুগে তাঁরা ভারতীয়
জনসমাজে বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেন।মহাভারত গ্রন্থে রামোপাখ্যান নামে রামায়ণের একটি
সারাংশ সংযোজিতহয়েছে;যুধিষ্ঠিরের নিকট কথিত এই উপাখ্যানে রামের চরিত্রে কোনো দেবত্ব
আরোপ করা হয়নি। গবেষকেরা মনে করেন, রামায়ণের প্রথম পর্বআদিকাণ্ডও শেষ পর্বউত্তরকাণ্ডপরবর্তীকালের
সংযোজন। দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ কাণ্ড পর্যন্ত মহাকাব্যটিই প্রাচীন অংশ। আদিকাণ্ডওউত্তরকাণ্ড-এর লেখক বা লেখকবৃন্দ উত্তর ভারতের পূর্বগাঙ্গেয় সমভূমিএবংষোড়শ মহাজন
পদের যুগের কোশল ওমগধ রাজ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। কারণ উক্ত অংশে এই সকল অঞ্চল সম্পর্কে
প্রদত্ত ভৌগোলিকও ভূরাজনৈতিক তথ্য এই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদিওঅরণ্যকাণ্ডথেকে
রাক্ষসবধকারীনায়ক ও নানাপ্রকার পৌরাণিক জীবজন্তুর উপস্থিতিতে সহসাই এই উপাখ্যান কল্পকাহিনিমূলক
হয়ে পড়েছে। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের ভৌগোলিক তথ্য এখানে অত্যন্ত অস্পষ্ট।লঙ্কাদ্বীপে
ভৌগোলিক অবস্থানটিও স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই সকল তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিক
এইচ. ডি. সঙ্কলিয়া খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীকে এই মহাকাব্যের রচনাকাল বলে উল্লেখ
করেন। এ. এল. ব্যাসাম অবশ্য এই মত প্রকাশ করেছেন যে রাম সম্ভবত ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব
অষ্টম অথবা সপ্তম শতাব্দীর এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতি। চরিত্রসীতারপার্শ্বে উপবিষ্টরাম,
পশ্চাতেলক্ষ্মণ,ভরতওশত্রুঘ্নদণ্ডায়মান; সম্মুখেহনুমানও অন্যান্য বানরেরা প্রণাম জানাচ্ছেন।
.রাম– এই উপাখ্যানের নায়ক।বিষ্ণুরসপ্তম অবতাররাম ছিলেন
রাজাদশরথও তাঁর জ্যৈষ্ঠা মহিষীকৌশল্যারজ্যৈষ্ঠ ও প্রিয়তম পুত্র। রামায়ণে রামকেমর্যাদা
পুরুষোত্তমঅর্থাৎ সর্বগুণের আধার বলে অভিহিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়া স্ত্রীকৈকেয়ীরচক্রান্তে
দশরথ রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে যাওয়ার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। রামও পিতার আজ্ঞা
শিরোধার্য করে বনবাসে গমন করেন।
.সীতা– রামের প্রিয়তমা পত্নী এবং রাজা জনকের পালিতা
কন্যা। সীতার অপর নাম জানকী। তিনি বিষ্ণুপত্নী দেবী লক্ষ্মীর অবতার। রামায়ণে তাঁকে
নারীজাতির আদর্শ স্থানীয়া বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি স্বামীর সঙ্গে বনবাসে গমন করেন।রাবণ
তাঁকে অপহরণ করে লঙ্কায় বন্দী করে রাখেন। রাম রাবণকে পরাজিত করে তাঁকে উদ্ধার করেন।
পরবর্তীকালে তিনি রামের দুই যমজ পুত্রলবওকুশেরজন্ম দেন।
.হনুমান–কিষ্কিন্ধ্যারাজ্যের একবানর। তিনিশিবের(একাদশ রুদ্র) অবতার এবং রামের আদর্শভক্ত। তাঁর পিতা বানররাজ কেশরী ও মাতা
অঞ্জনা। সীতারঅবস্থান নির্ণয় ও উদ্ধার তথা লঙ্কার যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা গ্রহণ করেন।
.লক্ষ্মণ– রামের ভ্রাতা। তিনি স্বেচ্ছায় রাম ওসীতার
সঙ্গে বনবাসে গমন করেন ও সেখানে তাঁদের রক্ষা করে চলেন। লক্ষ্মণ ছিলেন বিষ্ণুর সহচর
শেষ নাগের অবতার।মারীচের ছলনায় রামের বিপদাশঙ্কায় তিনি সীতাকে একাকী ফেলে যেতে বাধ্য
হন। সেই সুযোগে রাবণ সীতাকে অপহরণ করেন।
.রাবণ–লঙ্কার রাক্ষস রাজা। দশ হাজার বছর কঠোর তপস্যা
করে তিনি সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছ থেকেএই বর লাভ করেন যে কোনো দেব, দানব বা ভৌতিক
জীব তাঁকে বধ করতে পারবেন না। তিনি ছিলেন এক শক্তিশালী রাক্ষসরাজা। ঋষিদের উপর অত্যাচার
চালিয়ে করে তিনি বিশেষ আমোদ অনুভব করতেন। ব্রহ্মার বরদানকে এড়িয়ে তাঁকে হত্যা করার
জন্য বিষ্ণুকে মানব রূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়।
.দশরথ–অযোধ্যাররাজা ও রামের পিতা। তাঁর তিন পত্নী:কৌশল্যা,কৈকেয়ীওসুমিত্রাএবং
রাম ব্যতীত অপর তিন পুত্র:ভরত,লক্ষ্মণওশত্রুঘ্ন। দশরথের প্রিয়তমা পত্নীকৈকেয়ীতাঁকে
বাধ্য করেন রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠিয়ে ভরতকে যুবরাজ ঘোষণা করতে। রাম বনে
গেলে পুত্রশোকে দশরথের মৃত্যু হয়।
.ভরত– দশরথের পুত্র। যখন তিনি জানতে পারেন যে রামকে
বনে পাঠানোর প্রধান চক্রী তাঁর মা এবং তাঁরই জন্য পুত্রশোকে পিতার মৃত্যু হয়েছে, তখন
তিনি ঘৃণাভরে রাজপদ প্রত্যাখ্যান করে রামের অনুসন্ধানে বাহির হন। কিন্তু রাম প্রত্যাবর্তনে
অসম্মত হলে, তিনি রামের খড়ম দুখানি চেয়ে নেন। সেই খড়ম দুটি সিংহাসনে স্থাপন করে
পরবর্তী চোদ্দো বছর রামের নামে অযোধ্যা শাসন করেছিলেন ভরত।
.শত্রুঘ্ন– দশরথ ও সুমিত্রার পুত্র। তিনি রামেরকনিষ্ঠ
ও লক্ষ্মণের যমজ ভ্রাতা এবং শ্রুতকীরতিরপতি।
রামায়ণ অনুবাদ
বাংলা ভাষায় রামায়ণের প্রথম অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা। আনুমানিক ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দে
নদীয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়ায় শ্রীপঞ্চমী
তিথিতে রবিবারে কৃত্তিবাসের জন্ম হয়। কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষের নাম নরসিংহ ওঝা। ১২
বছর বয়সে কৃত্তিবাস বিদ্যার্জনের জন্য উত্তর দেশে গিয়েছিলেন।
'কৃত্তিবাসী রামায়ণ ' হিসেবে প্রচলিত, জনপ্রিয় গ্রন্থটি শ্রীরামপুরের খ্রিস্টীয়
যাজকেরা প্রথম মুদ্রিত করেন (১৮০২-০৩)। পরে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার দ্বিতীয়
সংস্করণে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন (১৮৩০-৩৪)।
কৃত্তিবাসের মূল রামায়ণের
অনুবাদকালে তাকে 'আপন মনের মাধুরী' মিশিয়ে রচনা করেছেন এবং কাব্যকায়াকে আধুনিক
করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থের নাম 'শ্রীরাম পাঁচালি'। বহু শতাব্দীব্যাপী
আপামর জনসাধারণের মধ্যে তাঁর কাব্যের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ রামায়ণের মূল
চরিত্রগুলির মধ্যে বাঙালি সমাজের প্রক্ষেপণ, কাব্যে প্রতিফলিত বাংলার পরিবেশ ও
প্রাত্যহিক জীবনচিত্র, ভক্তি ও করুণরসের সর্বজনগ্রাহ্যতা এবং সাধারণ মানুষের মননে
সহায়ক পাঁচালির ঢঙ। গবেষকদের অনুমান পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কবি তাঁর এই কাব্য
রচনা করেছিলেন।
রামায়ণের অনুবাদের ধারাঃ-
🔵 পঞ্চদশ শতাব্দী
:
কৃত্তিবাস ওঝা
- শ্রীরাম পাঁচালি
মাধব কন্দলি - শ্রীরাম পাঁচালি
🔵 ষোড়শ শতাব্দী :
শঙ্কর দেব- শ্রীরাম পাঁচালি (উত্তর কাণ্ড)
🔵 সপ্তদশ শতাব্দী
:
নিত্যানন্দ আচার্য- অদ্ভুত
আচার্যের রামায়ণ
রামশঙ্কর দত্ত- রাম কথা
দ্বিজ অথবা পতিত ভবানীনাথ- লক্ষ্মণ দ্বিগ্বিজয়
দ্বিজ শ্রীলক্ষণ- অধ্যাত্ম রামায়ণ
চন্দ্রাবতী- রামায়ণ
🔵 অষ্টাদশ শতাব্দী :
ফকির রাম কবিভূষণ - অঙ্গদ
রায়বার
রামচন্দ্র- বিভীষণের রায়বার
রামনারায়ণ-বিভীষণের রায়বার
কাশীরাম-কালনেমির রায়বার
দ্বিজ তুলসী- অঙ্গদ রায়বার
খোশাল শর্মা - অঙ্গদ রায়বার
জগন্নাথ দাস- লঙ্কাকাণ্ড
দ্বিজ দয়ারাম- তরণীসেনের যুদ্ধ
কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী -অধ্যাত্ম রামায়ণ
দ্বিজ শিবরাম- লক্ষ্মণ শক্তিশেল
উৎসবানন্দ- সীতার বনবাস
জগৎরাম রায়- অদ্ভুত রামায়ণ
কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর
রামায়ণের অনুবাদে যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অনেকাংশেই বাল্মীকির
প্রদর্শিত পথে না গিয়ে নিজ কল্পনা অনুসারে চরিত্র-চিত্রন ও ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
বীরত্বের গরিমা প্রচার নয়, রাম চরিত্রের
মাধুর্য বর্ণনাই তাঁর অন্বিষ্ট। তাঁর
কাব্যের মূল সুর ভক্তি। বাঙালি হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনাদর্শ, কল্পনা,
সমাজ-ভাবনা, জীবন-অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বাঙালির নৈতিক,
সামাজিক ও ধর্মজীবনে তাঁর কাব্যের বিপুল প্রভাব লক্ষ করা যায়।
চৈতন্যোত্তর যুগের
রামায়ণের মধ্যে 'অদ্ভুতাচার্যের রামায়ণ' উল্লেখযোগ্য। পাবনা জেলার অমৃতকুণ্ডা
গ্রামে ১৭ শ শতকের শেষভাগে আবির্ভূত সাঁতোলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি নিত্যানন্দ
আচার্যের এই রচনা উত্তরবঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কবি 'অদ্ভুত
রামায়ণ', 'অধ্যাত্ম রামায়ণ', 'রঘুবংশম্' থেকে তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ
করেছিলেন। ইনি ছাড়া আর যাঁরা বাংলায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হলেন- কৈলাস বসু, দ্বিজ ভবানীদাস, দ্বিজ শ্রীলক্ষ্মণ
চক্রবর্তী,কবিচন্দ্র প্রমুখ।
পদ্মাবতী
পদ্মাবতী মধ্যযুগের বাঙালি কবি আলাওলের একটি কাব্য। এটিকে
আলাওলের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে গণ্য করা হয়।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একটি ঊজ্জ্বল নিদর্শন আলাওলের অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ
‘পদ্মাবতী’। মালিক মুহম্মদ জায়সী এর ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের অনুবাদ এটি। জায়সী তাঁর কাব্য
রচনা করেন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে। প্রায় ১০০ বছর পর আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অমাত্য মাগন
ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে পদ্মাবতী রচনা করেন। কবি তখন মাগন
ঠাকুরের সভাসদ এবং আশ্রিত। পদ্মাবতী
কাব্যের কাহিনীতে ঐতিহাসিকতা কতটুকু তা নিশ্চিত হওয়া যায় নি। সম্ভবত কবিচিত্তের
কল্পনাই জায়সী এবং আলাওল দুজনকেই প্রভাবিত করেছিল। বাংলায় পদ্মাবতী রচনায় আলাওল
মূলত পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের আশ্রয় নিয়েছেন। মধ্যযুগের ধর্মীয় সাহিত্যের ঘনঘটার
মধ্যে এই পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ স্বতন্ত্ররীতির এক অনুপম শিল্পকর্ম। পদ্মাবতী মৌলিক
না হলেও সাবলীল ভাষার ব্যবহার ও মার্জিত ছন্দের নিপুণ প্রয়োগে তা আলাওলের
কবিপ্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে
চট্টগ্রাম-আরাকানে দুজন শক্তিমান মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে
যাদের অবদান যথেষ্ট। এঁরা হলেন দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল। এই কবিরা ধর্মনিরপেক্ষ দেবভাবনামুক্ত
অবিমিশ্র মানবিক চেতনার জয়গান গেয়েছেন—যা মধ্যযুগের গতানুগতিক ধারা থেকে স্বতন্ত্র।
ব্রহ্মদেশের নিম্নভাগের সংলগ্ন অঞ্চল ছিল আরাকান। এখানকার অধিবাসীরা ছিলেন মগ। রাজাও
ছিলেন মগ জাতীয় বৌদ্ধ। এই রাজাদের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় কবিরা কাব্য রচনা করেছিলেন।
কবি
পরিচয়ঃ
সপ্তদশ শতাব্দীর
রোসাঙ রাজসভার একজন মুসলমান কবি সৈয়দ আলাওল। সৈয়দ আলাওল রচিত ‘সেকেন্দারনামা’ ও ‘সয়ফুলমুলক’
গ্রন্থে কবির আত্মপরিচয় পাওয়া যায়। এই দুই গ্রন্থ অনুসারে জানা যায় আলাওল চট্টগ্রামে
( মতান্তরে ফরিদপুরে ) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহন করেন। ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা
মজলিস কুতুবের অমাত্য পুত্র সৈয়দ আলাওল। আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের মজলিস কুতুবের মন্ত্রী
ছিলেন। আলাওলের সময় আরকানের রাজা ছিলেন রাজা সুধর্মা। কবি ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।
কাব্য
পরিচয়ঃ
সৈয়দ আলাওলের কাব্যের সংখ্যা
৬টি (মতান্তরে ৭টি)। কাব্যগুলি যথাক্রমে ---
(i) ‘পদ্মাবতী’
-- ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দ।
(ii) ‘লোরচন্দ্রানী’র
শেষাংশ -- ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দ।
(iii) ‘সয়ফুলমূলক
বদউজ্জমাল’ -- ১৬৫৮ -৭০ খ্রিষ্টাব্দ।
(iv) ‘সপ্তপয়কর’
/ ‘হপ্তপয়কর’ -- ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ।
(v) ‘তোহফা’ -- ১৬৬৩
- ৬৯ খ্রিষ্টাব্দ।
(vi) ‘সেকেন্দারনামা’
-- ১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দ।
(vii) ‘রাগতালনামা’
(এই রচনাটি সৈয়দ আলাওলের কিনা সন্দেহ রয়েছে)।
কাব্য আলোচনাঃ
(i) ‘পদ্মাবতী’:-
➤ আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে
রচিত হয়।
➤ মহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য
অবলম্বনে এই কাব্য রচিত।
➤ এই কাব্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষক
মাগন ঠাকুর।
➤ ‘পদ্মাবতী’ ইতিহাসাশ্রিত
রোমান্টিক প্রেমকাব্য।
➤ ‘পদ্মাবতী’ ৫৬টি
খন্ডে বিন্যস্ত।
➤ সাধুভাষায় পয়ার ত্রিপদী
ছন্দে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন।
➤ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের
ইংরাজি অনুবাদ করেন গীয়ার্সন এবং শিরেফ।
➤ সাধুভাষায় পয়ার ত্রিপদী ছন্দে
আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন।
➤ এই কাব্যের চরিত্র - রত্নসেন,
নাগমতী, পদ্মাবতী, আলাউদ্দিন খিলজী।
➤ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের
বিষয়বস্তুঃ
সিংহল রাজকন্যা ও মেবারের রানি পদ্মাবতী বা পদ্মিনীকে
নিয়ে এই কাব্যটি রচিত। আলাউদ্দিন খিলজি রত্নসেনের রানি পদ্মিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে
শক্তিবলে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য চিতোর আক্রমণ করেন। এই দস্যুর কবল থেকে সতীত্বধর্ম রক্ষার্থে
পদ্মিনী জহরব্রতে আত্মত্যাগ করেন। মূল কাব্যে (জায়সির পদুমাবৎ) ইতিহাসের চেয়ে কল্পনার
প্রাধান্য বেশি, তা ছাড়া জায়সি সুফিসাধক ছিলেন বলেই উক্ত ঐতিহাসিক কাহিনিকে জীবাত্মা-পরমাত্মার
রূপ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
‘➤ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের উৎকর্ষতাঃ
‘পদ্মাবতী’ কাব্যই আলাওলের কবি
প্রতিভার প্রধান পরিচায়ক। এ কাব্যকে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের প্রথম সারির রচনার অন্তর্ভুক্ত
করা চলে। এ কাব্যে আছে জীবনের উদ্দাম উচ্ছ্বাস, অট্টহাস্য মুখরতা, বিচিত্র দুঃসাহসিক
অভিযানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সমকালীন রোসাঙ্গ বাজের সামরিক অবস্থার কাহিনীও স্থান পেয়েছে।
(ii) ‘লোরচন্দ্রানী’র
শেষাংশঃ
➤ আনুমানিক ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে
রচিত।
➤ এর উৎস ‘সতী ময়না’ আখ্যান।
➤ আরকান রাজের মহামাত্য সুলেমানের
নির্দেশে রচিত।
➤ দৌলত কাজীর অসাপ্ত কাব্য।
(iii) ‘সয়ফুলমূলক
বদিউজ্জমাল’
➤ আনুমানিক ১৬৫৮ - ৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত।
➤ এর উৎস ‘ইসলামী রোমান্টিক কাহিনী’।
➤ মাগন ঠাকুরের অনুরোধে রচিত।
➤ গ্রন্থটি আরবি থেকে অনুবাদ
করা।
➤ গ্রন্থের মূল বিষয়
ছিল মিশরের বাদশাহ ছিপিয়ানের পুত্র সয়ফুলমুলুকের সঙ্গে বােস্তানের রাজকন্যা বদিউজ্জমালের
. রোমান্টিক প্রণয় কাহিনী।
➤ এই কাব্যের নায়ক - সয়ফুল এবং
নায়িকা বদিউজ্জমাল।
➤ কাব্যের বিষয়বস্তুঃ
নায়ক সয়ফুলমূলক ও নায়িকা
বিদয়উজ্জমালের প্রেমকাহিনি এর বিষয়বস্তু। এই কাব্যটি মুসলিম সমাজে খুবই জনপ্রিয়।
মানব নায়কের সঙ্গে পরী প্রেমিকার মিলন কাহিনি লিখে আলাওল মানবলোক ও স্বপ্নলোকের মধ্যে
সেতুবন্ধ রচনা করেছিলেন। এই কাবোর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট স্বপ্নমেদর লোকাতীত পরিবেশ সৃষ্টি।
(iv) ‘সপ্তপয়কর’ / ‘হপ্তপয়কর’
➤ আনুমানিক ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত।
➤ এর উৎস ‘নেজামি সমরকন্দের
‘সপ্তপয়কর’।
➤ সৈয়দ মহম্মদের অনুরোধে রচিত।
➤ গ্রন্থটি আরবি থেকে অনুবাদ
করা।
➤ কাব্যের মূল বিষয়
হল আরবের রাজকুমার বাহরামের যুদ্ধ জয় ও তাঁকে তাঁর সাত রানির বলা গল্প।
(v) ‘তোহফা’
➤ আনুমানিক ১৬৬৩ - ৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত।
➤ এর উৎস সেখ রুসুফের ‘তুহফাতুন্নসা’ নামক ফরাসি নীতিকাব্য।
➤আরকান রাজের মহামাত্য সুলেমানের
নির্দেশে রচিত।
➤ কাব্যের বিষয় হল মুসলমান সমাজের নীতিকথা।
➤ গ্রন্থটি ফার্সি থেকে অনুবাদ
করা।
(vi) ‘সেকেন্দারনামা’
➤ আনুমানিক ১৬৬৩ - ৭২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত (তবে মনে করা হয় ১৬৬৩
খ্রিঃ রচিত)।
➤ এর উৎস নেজামি সমরকন্দের ‘ইসকান্দারনামা’
ফরাসি কাব্য।
➤ রাজা চন্দ্র সুধর্মার প্রধান
অমাত্য নবরাজ মজলিশের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত।
➤ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমনের
কাহিনী নিয়ে আলাওল ‘সেকেন্দারনামা’ রচনা করেন।
➤ গ্রন্থটি ফার্সি থেকে অনুবাদ করা।
➤ মনে করা হয় এটিই তার শেষ কাব্য।
➤ কাব্য পরিচয়ঃ
নেজামি সমরখন্দের
ফারসি কাব্য 'ইসকান্দার নামা'র সরস অনুবাদ। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সমরাভিযান ইসলামীয়
কায়দায় এখানে বর্ণিত। এই গ্রন্থে ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ ও রূপকথাধর্মী অনেক অদ্ভুত গল্প
স্থান পেয়েছে। সেগুলি চিত্তাকর্ষক হলেও কাব্যগুণের দিক থেকে নগণ্য।
সৈয়দ
আলাওলের কবি প্রতিভাঃ
আলাওল জীবনরসিক কবি।
তিনি বহুভাষাবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত কবি ছিলেন বলেই বহুপাত্র থেকে জীবনের রস আহরণ
করেছেন। তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতা স্বীকার্য। হিন্দু ও মুসলমান জ্ঞানে তিনি সমান পারদর্শী
ছিলেন। আলাওলের রচনা সরল অথচ প্রগাঢ়। 'পদ্মাবতী' তাঁর শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িকা। আলাওলের
কাব্যমালায় মাঝে মাঝে গান বা পদাবলি আছে। এগুলির কোনো কোনোটিতে তাঁর রচনাশক্তির বিশিষ্ট
পরিচয় পাই।
আলাওল
সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যঃ-
1. সপ্তদশ শতাব্দীর
রোসাঙ রাজসভার একজন মুসলমান কবি সৈয়দ আলাওল।
2. সৈয়দ আলাওল রচিত
‘সেকেন্দারনামা’ ও ‘সয়ফুলমুলক’ গ্রন্থে কবির আত্মপরিচয় পাওয়া যায়।
3. এই দুই গ্রন্থ
অনুসারে জানা যায় আলাওল চট্টগ্রামে ( মতান্তরে ফরিদপুরে ) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহন
করেন।
4. ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা
মজলিস কুতুবের অমাত্য পুত্র সৈয়দ আলাওল।
5. আলাওলের পিতা
ফতেহাবাদের মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন।
6. আলাওলের সময় আরকানের
রাজা ছিলেন রাজা সুধর্মা।
7. কবি ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে
মারা যান।
8. সৈয়দ আলাওলের
কাব্যের সংখ্যা ৬টি (মতান্তরে ৭টি )।
9. ‘পদ্মাবতী’ ইতিহাসাশ্রিত
রোমান্টি প্রেমকাব্য।
10. ‘পদ্মাবতী’ ৫৬টি
খন্ডে বিন্যস্ত।
11. সাধুভাষায় পয়ার
ত্রিপদী ছন্দে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন।
12. ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের
ইংরাজি অনুবাদ করেন গীয়ার্সন এবং শিরেফ।
13. দৌলত কাজির অসমাপ্ত
কাব্য ‘লোরচন্দ্রানী’ বা ‘সতীময়না’ শেষ করেন সৈয়দ আলাওল।
14. আলেকজান্ডারের
ভারত আক্রমনের কাহিনী নিয়ে আলাওল ‘সেকেন্দারনামা’ রচনা করেন।
15. সৈয়দ আলাওল আরবি
থেকে অনুবাদ করেন ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল’ ও ‘সপ্তপয়কর’।
16. সৈয়দ আলাওল ফার্সি
থেকে অনুবাদ করেন ‘তোহফা’ ও ‘সেকেন্দারনামা’।
17. সৈয়দ আলাওলের
‘তোহফা’ ইসলামীয় নীতিকথা।
18. আলাওলের লেখা
দুটি প্রনয় কাব্য ‘পদ্মাবতী’ ও ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল’।
19. সৈয়দ আলাওলের
লেখা সর্বশেষ গ্রন্থ ‘সেকেন্দারনামা’।
20. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
সাহেব ঢাকা থেকে ‘পদ্মাবতী’র নতুন সংস্করণ সম্পাদনা করেছেন।
মহাভারত
মহাভারত সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের অন্যতম (অপরটি হল রামায়ণ)। এই
মহাকাব্যটি হিন্দুশাস্ত্রের ইতিহাস অংশের অন্তর্গত।
মহাভারতের মূল উপজীব্য
বিষয় হল কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর
ঘটনাবলি। তবে এই আখ্যানভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা
যায়, ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ – এই চার পুরুষার্থ-সংক্রান্ত
একটি আলোচনা (১২।১৬১) সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে। মহাভারত-এর
অন্তর্গত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা ও উপাখ্যানগুলি হল ভগবদ্গীতা, দময়ন্তীর উপাখ্যান, রামায়ণ-এর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠান্তর ইত্যাদি; তবে এগুলিকে মহাভারত-রচয়িতার নিজস্ব সৃষ্টি বলে মনে করা হয়।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব(
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস )। অনেক গবেষক এই মহাকাব্যের ঐতিহাসিক বিকাশ ও রচনাকালীন
স্তরগুলি নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধুনা প্রাপ্ত পাঠটির প্রাচীনতম অংশটি মোটামুটি ৪০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ গুপ্তযুগে রচিত হয়। মহাভারতের
মূলপাঠটি তার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে গুপ্তযুগের প্রথমাংশে (খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী)। মহাভারত কথাটির অর্থ হল ভরত বংশের মহান উপাখ্যান। গ্রন্থেই উল্লিখিত হয়েছে যে ভারত নামে ২৪,০০০
শ্লোকবিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্রতর আখ্যান থেকে মহাভারত মহাকাব্যের কাহিনিটি বিস্তার লাভ করে। তবে ব্যাস প্রথমে ৮৮০০
শ্লোক বিশিষ্ট জয়া (বিজয়) নামক
একটি গ্রন্থ রচনা করেন। পরে ব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন সেই গ্রন্থকে বৃদ্ধি করে ২৪০০০ শ্লোক বিশিষ্ট ভারত গ্রন্থ রচনা
করেন। পরে অপর এক শিষ্য উগ্রশ্রবাঃ ভারত গ্রন্থকে বৃদ্ধি
করে এক লাখ শ্লোক বিশিষ্ট "মহাভারত" গ্রন্থ রচনা করেন। মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোক ও দীর্ঘ গদ্যাংশ রয়েছে। এই মহাকাব্যের শব্দসংখ্যা
প্রায় আঠারো লক্ষ। মহাভারত মহাকাব্যটির আয়তন ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যদ্বয়ের সম্মিলিত আয়তনের দশগুণ এবং রামায়ণের চারগুণ।
রচনাকাল
মহর্ষি বেদব্যাস কথিত মহাভারতের কাহিনি
রচনা করতে সম্ভবত ৩ বৎসর কাল অতিবাহিত হয়েছিল, এর দ্বারা অনুমান করা যেতে পারে, ঐ
সময় লিখন পদ্ধতি তেমন আধুনিক ছিল না, সে কালে প্রচলিত নানা বৈদিক সাহিত্যগুলোকে মুনিঋষিরা
গুরু-শিষ্য পরম্পরা অনুসারে নিজেরা মৌখিক
রূপে স্মরণ করে রাখতেন। সে সময় আর্য ভাষা সংস্কৃত ঋষিদের মান্য ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। এই রূপে সমগ্র বৈদিক সাহিত্য তথাকথিত গুরু-শিষ্য
পরম্পরায় মৌখিক রূপে সংরক্ষিত থাকত। এরপর সময়ের সাথে সাথে বৈদিক যুগের পতন হয় এবং
সেই প্রাচীন গুরু-শিষ্য পরম্পরায় স্মরণ করার রীতি লুপ্ত হয়, তখন সেই সমস্ত সাহিত্যগুলিকে
লিখিত রূপে সংরক্ষণের রীতি প্রচলিত হয়। এই সময় ব্রাহ্মী লিপির মাধ্যমে লেখার প্রচলন ঘটে। বর্তমান পণ্ডিতগণের ধারণা যে, মহাভারত
প্রাচীন অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানো কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।
গবেষকদের মতে, মহাভারতের রচনাকাল ৩টি প্রারম্ভিক স্তরে বিভক্ত। এই ৩ স্তরের সময়কাল নিম্নরূপ :
·
৩১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
ক.
সর্বপ্রথমে ব্যাসদেব ১৮ পর্ব, ১০০ উপপর্ব
ও এক লক্ষ শ্লোক সমন্বিত 'জয়' গ্রন্থ রচনা করেন, যা পরবর্তী কালে মহাভারত নামে প্রসিদ্ধ
হয়।
খ.
পরে ব্যাস প্রচারিত ঐ কাহিনিটিকে তার শিষ্য বৈশম্পায়ন জনমেজয়ের মহা যজ্ঞে জনমেজয় সহ সৌতি অন্যান্য মুনিদের শোনান। এই সময় গ্রন্থটির নাম হয় 'ভারত'।
·
২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
তৃতীয়
বার বৈশম্পায়ন কথিত ভারত কাহিনিটিকে সৌতি ১৮টি খণ্ডে বিভক্ত করেন ও নৈমিষারণ্যে স্থিত শৌনক ও অন্যান্য মুনিদের
গল্পের আকারে শোনান। সৌতির এই গল্পটিই 'মহাভারত' নামে সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হয়।
·
১২০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ
পরে
লিখন পদ্ধতির উন্নতি হলে সৌতি প্রচারিত এই প্রসিদ্ধ মহাভারতের কাহিনি পাণ্ডুলিপি বা পুঁথিতে ব্রাহ্মী কিংবা সংস্কৃতে লিখিত হয়। এর পরও
নানা মুনি ও পণ্ডিতরা নিজস্ব শৈলীতে মহাভারতের মূল কাহিনির সাথে আরও অনেক সমসাময়িক
কাহিনির সংযোজন করেন।
চরিত্র সমূহ
·
অভিমন্যু : অর্জুন ও সুভদ্রার বীর পুত্র, মহাযুদ্ধে চক্রব্যূহে নিহত হন। অভিমন্যু ও উত্তরার পুত্র হল
পরীক্ষিৎ।মহাভারতের যুদ্ধে কৌরব পক্ষের মহারথীরা অভিমুন্য কে ছল করে হত্যা করেছিল
·
অর্জুন : দেবরাজ ইন্দ্রের বরজাত পাণ্ডু
ও কুন্তীর তৃতীয় পুত্র, যিনি
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে গণ্য হন।
·
অশ্বত্থামা : গুরু দ্রোণাচার্য ও কৃপীর অমর পুত্র ও দুর্যোধনের মিত্র।
·
কর্ণ : সূর্যদেবের বরজাত অবিবাহিতা কুন্তীর ধার্মিক দানবীর পুত্র, যিনি কবচ-কুণ্ডল নিয়ে জন্মেছিলেন।
·
কুন্তী : কুন্তীভোজের পালিতা কন্যা ও পাণ্ডুর স্ত্রী, এঁর তিন পুত্র – যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন।
·
গান্ধারী : গান্ধাররাজ সুবলের কন্যা ও
ধৃতরাষ্ট্রের ধর্মপরায়ণ পত্নী।
·
দুঃশাসন : শতকৌরবের ২য় কৌরব, দ্যুতসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেন।
·
দুর্যোধন : ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর
জ্যেষ্ঠ কৌরব পুত্র, গদাযুদ্ধে পারদর্শী ও
অন্যতম খলচরিত্র।
·
দ্রোণাচার্য : কুরু রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষক ব্রাহ্মণ গুরু, অশ্বত্থামার পিতা।
·
দ্রৌপদী : পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা ও পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী, এঁর সম্মানরক্ষাহেতু মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
·
ধৃতরাষ্ট্র : বিচিত্রবীর্য ও অম্বিকার অন্ধ
পুত্র, যার শতপুত্র কৌরব নামে পরিচিত।
·
নকুল : অশ্বিনীকুমারের বরজাত মাদ্রীর পুত্র ৪র্থ পাণ্ডব, অসিচালনায় পারদর্শী।
·
পাণ্ডু : বিচিত্রবীর্য ও অম্বালিকার
পুত্র, যার পাঁচ পুত্র পাণ্ডব নামে
পরিচিত।
·
বিদুর : অম্বিকার দাসীর ধর্মজ্ঞানী পুত্র, পাণ্ডব ও কৌরবদের সম্পর্কে কাকা হন।
·
ব্যাসদেব : মহাভারতের রচয়িতা মহান ঋষি, যদিও কাহিনিতেও এঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু এঁরই ঔরসজাত।
·
ভীম : পবনদেবের বরজাত দ্বিতীয় পাণ্ডব, মহাশক্তিধর গদাধারী, মহাযুদ্ধে
দুর্যোধনকে হত্যা করেন।
·
ভীষ্ম : মহারাজ শান্তনু ও গঙ্গাদেবীর বীর পুত্র, পিতৃসত্য পালনের জন্য ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করেন।
·
যুধিষ্ঠির : ধর্মের বরজাত জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব, ধার্মিকতা ও সত্যবাদিতার জন্য খ্যাত।
·
শকুনি : গান্ধাররাজ সুবলের পু্ত্র কপট দ্যুতক্রীড়ায় পারদর্শী
অন্যতম খলচরিত্র, কৌরবদের পরামর্শদানকারী
মামা।
·
শল্য : পাণ্ডুর স্ত্রী মাদ্রীর ভ্রাতা ও পাণ্ডবদের মামা, দুর্যোধনের ছলনায় যুদ্ধে কৌরবপক্ষ গ্রহণে বাধ্য হন।
·
শ্রীকৃষ্ণ : বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র, ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার, জগতে
ধর্মরক্ষাহেতু আবির্ভূত হন।
·
সত্যবতী : শান্তনুর ২য় পত্নী, মৎস্যগন্ধা নামে পরিচিত, পুত্রের
নাম – চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য।
·
সহদেব : অশ্বিনীকুমারের বরজাত মাদ্রীর পুত্র শেষ পাণ্ডব, জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী।
এছাড়াও মহাভারতে কৃপাচার্য, ঘটোৎকচ, দ্রুপদ, বলরাম, বিরাট, শান্তনু এবং অসংখ্য প্রধান-অপ্রধান চরিত্র রয়েছে।
ভারতচন্দ্র রায়
অষ্টাদশ শতকের শ্রেষ্ট কবি এবং মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি
হিসেবে সুপরিচিত ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর।
অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর।
ভারতচন্দ্র ‘রায় গুণাকর’ উপাধি প্রদান করেন নবদ্বীপের রাজা
কৃষ্ণচন্দ্র।
ভারতচন্দ্র সভাকবি ছিলেন
নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
ভারতচন্দ্রের রায় রচিত মঙ্গল কাব্যর নাম অন্নদামঙ্গল কাব্য।
ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জন্মস্থান হাওড়া জেলার পেঁড়ো (পান্তুয়া)
গ্রামে।
কবি ভারত চন্দ্র রায় গুনাকর জীবানাবসানের মাধ্যমে মধ্যযুগের
অবসান হয়েছে।
লোকসাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের শেকড় সন্ধানী সাহিত্য লোকসাহিত্য
লোক সাহিত্যের প্রাচীনতম সৃস্টি ছড়া ও ধাঁ ধাঁ. ‘মহুয়া পালা’
বেদের এক অপূর্ব সুন্দরী কন্যা মহুয়ার সাথে বামনকান্দার জমিদার ব্রাহ্মন যুবক নদের
চাঁদের প্রনয় কাহিনী নিয়ে রচিত।
মৈয়মনসিংহ গীতিকা
বাংলাদেশ থেকে সংগৃহিত লোক গীতিকা ৩ ভাগে বিভক্ত -নাথ-গীতিকা,
মৈয়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা।
মৈয়মনসিংহ গীতিকার অর্ন্তগত উল্লেখযোগ্য গীতিকাগুলো মহুয়া,
চন্দ্রাবতী, কাজল রেখা, দেওয়ানা মদিনা প্রভৃতি।
‘দেওয়ানা মদিনা’ পালাটির রচয়িতা মনসুর বয়াতি।
মৈয়মনসিংহ গীতিকা বিশ্বের ২৩ টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে
গীতিকার রচয়িতা ড. দীনেশ চন্দ্র সেন
মৈয়সনসিংহ গীতিকা ১৯২৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়
আরো জেনে রাখুন
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের মুসলমান কবিগণের সর্বাপেক্ষা
উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান।
মধ্যযুগে ফারসি ভাষা থেকে অনুদিত প্রণয়োপাখ্যানগুলো হল ইউসুফ-জুলেখা,
লাইলী-মজনু, গুলে বকাওয়ালী, সয়-ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সপ্তপয়কর ইত্যাদি।
মধ্যযুগে হিন্দী ভাষা থেকে অনুদিত প্রণয়োপাখ্যানগুলো হল
পদ্মাবতী, সতী ময়না লোরচন্দ্রনী, মধুমালতী, মৃগাবতী ইত্যাদি।
‘গুলে বকাওয়ালী’ রচনা করেন নওয়াজিশ আলী খান।
সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল কাব্যের কাহিনী আরবিয় উপন্যাস বা আলেফ
লায়লা।
সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ রচনা করেন আলাওল।
সপ্তপয়কর পারস্যর কবি নিজামী গঞ্জভীর সপ্তপয়কর রচনার ভাবানুবাদ।
লাইলী মজনু বাহরাম খান রচনা করেন।
ইউসুফ-জুলেখা শাহ মুহম্মদ সগীর রচনা করেন।
‘ইউসুফ-জুলেখা’ আরো রচনা করেন -
আব্দুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গোলাম সাফাতউল্লাহ, সাদেক আলী ও ফকির মুহাম্মদ।
মর্সিয়া সাহিত্য এক ধরনের শোককাব্য। বাংলা সাহিত্যে
মর্সিয়া সাহিত্য ধারার প্রথম কবি শেখ ফয়জুল্লাহ এবং তাঁর
কাব্যের নাম জয়নবের চৌতিশা।
অনুবাদ
সাহিত্য
অনুবাদ
সাহিত্যগুলো সংষ্কৃত,হিন্দী,আরবী,ও ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।এগুলোর বেশিরভাগই
রোমান্টিক প্রনয়োপাখ্যান ও দোভাষী পুথি।
ফারসী থেকে
অনূবাদ---
· শাহ মুহম্মদ
সগীর (ইউসুফ জোলেখা)। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি।
· দৌলত উজির
বাহরাম খান(লাইলী মজনু)।
· গরীবুল্লাহ
(জঙ্গনামা)।
·
আলাওল(হপ্তপয়কর,সিকান্দারনামা,সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল,তোহফা)
হিন্দী থেকে
অনুবাদঃ
· দৌলত
কাজী(সতীময়না ও লোর চন্দ্রানী)।
· আলাওল(
পদ্মাবতী)
সংষ্কৃত থেকেঃ
· রামায়ণ— ·
প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অনুবাদক –কৃত্তিবাস। · মহিলা অনুবাদক –চন্দ্রাবতী। ইনিই বাংলা
সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি।
· মহাভারত- ·
প্রথম অনুবাদক- শ্রীকর নন্দী · শ্রেষ্ঠ অনুবাদক-কাশীরাম দাস
হিন্দু লেখকদের
অনূদিত সাহিত্যের নাম সাহিত্যের কথা এবং মুসলিম লেখকদের অনূদিত সাহিত্যের নাম
রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান।
রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান
মধ্যযুগে
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান কাহিনিকাব্য বা রোমান্টিক প্রণয়োখ্যান।
মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসে সুলতানি আমলে। মুসলিম কবিরা হিন্দি
ও আরবি-ফারসি ভাষার সাহিত্য উৎস হতে উপকরণ নিয়ে যে পেমমূলক কাব্য রচনা করেছিলেন তাই
“রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান”। এ ধারার প্রথম কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর। চতুদর্শ শতকের শেষ
ও পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিয়ে তিনি “ইউসুফ জুলেখা” রচনার মধ্য দিয়ে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান
ধারার সূচনা করেন।
ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু,
হানিফ-কয়রাপরী, ছয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামান, সতীময়না-লোরচন্দ্রানী, পদ্মাবতী,
গুলেবকাওলী প্রভৃতি কাব্যে ধর্ম নেই জীবন আছে। সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলনপূর্ণ মানব
জীবনের কথা লৌকক ও অলৌকিক উপাদানের সাথে
মিশ্রিত হয়ে আনন্দরসের নতুন ভুবন রচনা করেছে। কাব্যের নাম
থেকেই বোঝা যায় বিষয়বস্তু মৌলিক নয়; মধ্যযুগের কবিরা মৌলিক বিষয়ের সন্ধান পাননি
অবিকশিত ব্যক্তিত্বও ব্যক্তি স্বতন্ত্র্যের অভাবের কারণে।
লোকোকাহিনী, পুরাণকাহিনী অনুসৃত হওয়ায় সেগুলির কাল্পনিক অলৌকিক
উপাদান মানব জীবনকে লঘু রসে সিক্ত করেছে।লঘু-গুরু, বাস্তব-অবাস্তব, মানবিক-দানবিক
মিশ্রভাবের এসব রচনাকে কেউ
"রোমান্টিক প্রেমকাব্য" কেউ "রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান" বা "রোমান্স কাব্য" বলেছেন।
রোমান্টিক কাব্যের
রচনাকালের পরিধি মধ্যযুগ ধরেই। মধ্যযুগের
বাংলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যায় চৌদ্দ শতক থেকে। ঐ শতকের শেষ দিকে অথবা পনের শতকের
গোড়াতে ইউসুফ জোলেখা কাব্যের দ্বারা এ ধারার প্রথম দ্বার উন্মোচিত হয়। অঠারো শতক পর্যন্ত এ ধারার রচনা অব্যাহত থাকে।
উল্লেখযোগ্য
মুসলিম সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মঃ
সাহিত্য |
কবি |
শতক |
ইউসুফ
জুলেখা |
শাহ
মুহম্মদ সগীর |
পনের
শতক |
পদ্মাবতী |
আলাওল |
সতের
শতক |
চন্দ্রাবতী |
কোরেশী
মাগন ঠাকুর |
সতের
শতক |
হপ্তপয়কর |
আলাওল |
সতের
শতক |
সতীময়না-লোরচন্দ্রানী |
দেীলত
কাজী |
ষোলো
শতক |
রসুল
বিজয় |
জয়েন
উদ্দিন |
পনের
শতক |
সায়াৎনামা |
মুজাম্মিল |
পনের
শতক |
লায়লী-মজনু |
দেীলত
উজির বাহরাম খান ( তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী ) |
ষোলো
শতক |
মধুমালতী |
মুহম্মদ
কবীর |
ষোলো
শতক |
হানিফা-কয়রাপরী |
সাবিরিদ
খান |
ষোলো
শতক |
বিদ্যাসুন্দর |
সাবিরিদ
খান |
ষোলো
শতক |
সয়ফুলমুলুক
বদিউজ্জামান |
দোনাগাজী
চেীধুরী, আলাওল |
ষোলো
শতক |
লালমতি
সয়ফুলমুলুক |
আবদুল
হাকিম |
সতের
শতক |
গুলে
বকাওলী |
নওয়াজিস
খান |
সতের
শতক |
শাহজালাল-মধুমালা |
মঙ্গল
চাঁদ |
সতের
শতক |
জেবলমুলুক
শামারোখ |
সৈয়দ
মুহম্মদ আকবর |
সতের
শতক |
মৃগাবতী |
মুহম্মদ
মুকিম |
সতের
শতক |
গদামল্লিকা |
শেখ
সাদী |
আঠারো
শতক |
চেীদ্ধ শতকের শেষ দিকে বা পনের
শতকের শুরুর দিকে হিন্দু কবিদের পাশাপাশি মুসলমান কবিরা অনুবাদের কাজে হাত দেন। মধ্যযুগে
বাংলা সাহিত্য ছিল পুরোপুরি দেবতাকেন্দ্রিক। এসময় মুসলমান কবিরা আরবি, ফারসি ও হিন্দি
প্রণয়মূলক কাব্যগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে শুরু করেন। শাহ মুহম্মদ সগীর বাংলা ভাষায় প্রথম
মুসলমান কবি। এদের মধ্যে রয়েছেন:
দেীলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ
কবির, সাবিরিদ খান, দেীলত কাজী, আবদুল হাকিম, আলাওল, মাগন ঠাকুর প্রমুখ এ যুগের উল্লেখযোগ্য
কবি।
উল্লেখযোগ্য
পৃষ্ঠপোষক ও কবিঃ
কবি |
কাব্য |
পৃষ্ঠপোষক |
শাহ
মুহম্মদ সগীর |
ইউসুফ
জুলেখা |
গিয়াসউদ্দিন
আজম খান |
কৃত্তিবাস |
রামায়ণ |
জালালুদ্দিন
মুহম্মদ শাহ |
মালাধর
বসু |
শ্রীকৃষ্ণ
বিজয় |
রুকনউদ্দিন
বারবক শাহ |
জৈনুদ্দিন |
রসুলবিজয় |
শামসুদ্দিন
ইউসুফ শাহ |
বিপ্রদাশ |
মনাসাবিজয় |
আলাউদ্দিন
হোসেন শাহ |
বিজয়গুপ্ত |
মনসামঙ্গল |
আলাউদ্দিন
হোসেন শাহ |
যশোরাজ
খান |
বৈষ্ণবপদ |
আলাউদ্দিন
হোসেন শাহ |
কবীন্দ্র
পরমেশ্বর |
মহাভারত |
হুসেন
শাহের সেনাপতি পরাগল খান |
বিদ্যাপতি |
বৈষ্ণবপদ |
নাসিরুদ্দিন
নুসরত শাহ |
শেখ
কবির |
বৈষ্ণবপদ |
নাসিরুদ্দিন
নুসরত শাহ |
শ্রীধর |
বিদ্যাসুন্দর |
আলাউদ্দিন
ফিরোজ শাহ |
আলাওল |
পদ্মাবতী,
তোহফা, সিকান্দারনামা |
কোরেশী
মাগন ঠাকুর, শ্রীমন্ত সোলেমান, নবরাজ মজলিস। |
কবিগণ এসব কাব্যে
মানবপ্রেমের জয়গান করেছেন। মানব-মানবীর হৃদয়ের সুখ-দুখঃ আনন্দ-বেদনার প্রতিফলন
ঘটিয়েছেন। মূল কাব্যের লক্ষ্য অনেক ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিক প্রেম হলেও বাংলা ভাষায়
পরিবেশনকালে তা আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাতে মানবপ্রেমের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত
হয়েছে। এই সকল কাব্য গুলোতে মানবপ্রেমের জয় ঘোষণা করতে গিয়ে কবিগণ নর-নারীর
দেহগত প্রেমের কথাই বেশি বলেছেন। বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই সংযোগ থাকার ফলেই প্রণয়কাব্য
গুলোর আবেদন হৃদয়গ্রাহী।
বাংলা রোমান্টিক
প্রণয়োপখ্যান গুলোর একটি অংশ আরাকান রাজসভার কবি গানের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।কবি
দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর ও আলাওলের মত প্রভাবশালী কবি আরাকান রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রোমান্টিক কাব্য রচনা
করেছিলেন। দৌলত কাজীর সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী, কোরেশী মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবত, আলাওলের পদ্মাবতী ও সাইফুল মুলক বদিউজ্জামাল বাংলা সাহিত্যের
রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যানের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য কাব্য।
ইউসুফ জুলেখা কাব্য
রচনার মধ্য দিয়ে এই ধারার শুরু। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি হিসেবে শাহ
মুহাম্মদ সগীর বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তিনি গৌড়ের সুলতান
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে ইউসুফ জুলেখা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি ১৫ শতকে
প্রথম দশকে রচিত বলে মনে করা হয়। বাইবেল ও কুরআনের নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে
সংক্ষেপে এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ইরানের মহাকবি ফেরদৌসীর কাব্যের রোমান্টিক
বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যের যথেষ্ট মিল বিদ্যমান। ইরানের
আধ্যাত্মিক কাব্য ও ভারতের লোক-কাহিনীর মিশ্রণে ইউসুফ
জুলেখা কাব্যের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি নির্মাণ করেন।
জীবনী
সাহিত্যঃ শ্রী চৈতন্য দেবের জীবন
নিয়ে লেখা। বিখ্যাত হলঃ ১। চৈতন্যভাগবত-বৃন্দাবন দাস ২। চৈতন্যমঙ্গল-লোচনদাস
৩।চৈতন্যচরতামৃত-কৃষ্ণদাস কবিরাজ
নাথ
সাহিত্যঃ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে
নাথধর্মের কাহিনী অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য নাথ সাহিত্য নামে পরিচিত। শিবের
উপাসকদের নাথ ধর্মী বলে। জর্জ গ্রীয়ার্সন রংপুরের কৃষকদের কাছ থেকে এ সাহিত্য
সংগ্রহ করেন। শেখ ফয়জুল্লাহ নাথ সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। ময়নামতির গান ও
গোরক্ষবিজয়(শেখ ফয়জুল্লাহ) এ শাখার সাহিত্য।
মর্সিয়া
সাহিত্যঃ মর্সিয়া শব্দের অর্থ শোক।হাসান
ও হোসেনের করুন কাহিনী নিয়ে এ সাহিত্যের সৃষ্টি।এ শাখার আদি কবি শেখ ফয়জুল্লাহ।জয়নাবের
চৌতিশা (ফয়জুল্লাহ), জঙ্গনামা(বাহারাম খান )।
লোকসাহিত্যঃ লোকসাহিত্য
হল মানুষের মুখে মুখে রচিত ও সংরক্ষিত কথা,ছড়া,গান,কাহিনী, ও গল্প। লোকসাহিত্যের
মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল গীতিকা,ছড়া,গান,ধা ধা,প্রবাদ,প্রবচন ইত্যাদি। হারামনি একটি
প্রাচীন লোকগীতি সংকলন।সম্পাদক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন। বাংলা লোকসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ
গোবেষক ড.মযহারুল ইসলাম।
আরাকান রাজসভা
বাংলার বাইরে
বর্তমান মায়ানমারের রাজধানী আরাকানে কিছু কবি বাংলা সাহিত্য চর্চা করেছেন। তাদের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনঃ
· দৌলত কাজী(সতী
ময়না লোরচন্দ্রানী, সমাপ্ত করেন আলাওল )
·
আলাওল(পদ্মাবতী, হপ্তপয়কর, সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল, তোহফা, সিকান্দারনাম )
· কোরেশী মাগন
ঠাকুর (চন্দ্রাবতী)
·
মরদন(নসীরানামা)
মধ্যযুগের
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ
- মধ্যযুগের
প্রথম নিদর্শন –শ্রীকৃষ্ণকীর্তন - মধ্যযুগের প্রথম কবি-বড়ু চণ্ডিদাস - মধ্যযুগের
সাহিত্যে ব্যাতিক্রমী ধারার সাহিত্য –রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। - ব্যাক্তি হিসেবে
একটি পদ না লিখেও চৈতন্যদেবের নামে যুগের সৃষ্টি হয়েছে।- মধ্যযুগের সবচেয়ে সমৃদ্ধ
ধারা বৈষ্ণব পদাবলী।- মধযুগের শেষ কবি –ভারতচন্দ্র।
রাজসভার
সাহিত্য
রাজসভার
সাহিত্য হল রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত সাহিত্য। মধ্যযুগের প্রধান রাজসভার কবি ছিলেন
আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩) এবং ভারত চন্দ্র প্রমুখ। মহাকবি আলাওল ছিলেন আরাকান রাজসভার
প্রধান কবি। তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষায় কাব্য রচনা করেছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও
তার আয়ত্তে ছিল। প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে
বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয়
দিয়েছেন। আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৮ খৃ:) ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত মহাকাব্য। তাছাড়া :
সতীময়না লোরচন্দ্রানী (১৬৫৯খৃঃ)
সপ্ত পয়কর (১৬৬৫ খৃঃ)
সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল (১৬৬৯খৃঃ)
সিকান্দরনামা (১৬৭৩খৃঃ)
তোহফা (১৬৬৪ খৃঃ)
রাগতালনামা
মধ্যযুগের
শেষ এবং আধুনিক যুগের প্রধান কবি ছিল ভারত চন্দ্র। তিনি তার অন্নদামঙ্গল কাব্যের
মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই কাব্যের বিখ্যাত উক্তি হল,”আমার সন্তান
যেন থাকে দুধে ভাতে"।
শিবায়ন
কাব্য
শিবায়ন কাব্য
মধ্যযুগীয় বাংলা আখ্যানকাব্যের একটি ধারা। শিব ও দুর্গার দরিদ্র সংসার জীবন
কল্পনা করে মঙ্গলকাব্যের আদলে এই কাব্যধারার উদ্ভব। শিবায়ন কাব্যে দুটি অংশ দেখা
যায় – পৌরাণিক ও লৌকিক। মঙ্গলকাব্যের আদলে রচিত হলেও শিবায়ন মঙ্গলকাব্য নয়,
মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এক কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই কাব্যের দুটি ধারা দেখা
যায়। প্রথমটি মৃগলুব্ধ-মূলক উপাখ্যান ও দ্বিতীয়টি শিবপুরাণ-নির্ভর শিবায়ন কাব্য।
শিবায়নের প্রধান কবিরা হলেন রতিদেব, রামরাজা, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, রামচন্দ্র
কবিচন্দ্র ও শঙ্কর কবিচন্দ্র।
শাক্তপদাবলি
শাক্তপদাবলী
হল কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা। এই শ্রেণীর সঙ্গীত
শাক্তপদাবলীর একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে
বিশ্বাসী ছিলেন বলে শাক্তপদাবলীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শাক্তপদাবলীর
পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের
আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে
গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে। এই কারণে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি
আত্মনিবেদনের ঘনিষ্ঠ আকুতি শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে অপূর্ব কাব্যময় হয়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, সমাজজীবন ও লৌকিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এই পদাবলির অধ্যাত্মতত্ত্ব
শেষাবধি পর্যবসিত হয়েছে এক জীবনমুখী কাব্যে।
শাক্তপদাবলী ধারাটি বিকাশলাভ
করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই সময় বঙ্গদেশে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক
রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকালে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের পরিবর্তে শাক্তদর্শন ও
শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তার কারণ দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার
সতীরুপের শক্তিপীঠগুলির অনেকগুলিই বঙ্গদেশে। সেই শক্তিপীঠগুলিকে কেন্দ্র করে
প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে এসেছে শক্তিসাধনা। তারই ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত হয়
শাক্তসাহিত্য। শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন এবং তার পরেই স্থান
কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের। এই দুই দিকপাল শাক্তপদকর্তা ছাড়াও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ
শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পদকর্তা এই ধারায় সংগীতরচনা করে শাক্তসাহিত্য ও
সর্বোপরি শাক্তসাধনাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – কৃষ্ণচন্দ্র
রায়, শম্ভুচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, হরুঠাকুর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রামনিধি
গুপ্ত (নিধুবাবু), কালী মির্জা, দাশরথি রায় (দাশুরায়) প্রমুখ। অনেক মুসলমান কবিও
শাক্তপদাবলী ধারায় নিজ নিজ কৃতিত্ব স্থাপন করে গেছেন। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ
শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে এই শতাব্দীর জনপ্রিয়
শ্যামাসঙ্গীত গায়কদের অন্যতম হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য,
রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
নাথসাহিত্য
বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে
নাথধর্মের কাহিনি অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য।প্রাচীনকালে শিব উপাসক এক
সম্প্রাদয় ছিল,তাদের ধর্ম ছিল নাথধর্ম।হাজার বছর আগে ভারতে এই সম্প্রাদয় খ্যাতি
লাভ করেছিল। তাদের গতিবিধির ব্যাপকতার জন্য সারা ভারতবর্ষে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে
পড়েছিল। নাথ অর্থ প্রভু,দীক্ষালাভের পর নামের সাথে তারা নাথ শব্দটি যোগ করত। তারা
বিশেষ ক্ষমতার অধিকারি ছিল। বৌদ্ধ ও শৈব ধর্মের সমন্বয়ে এ ধর্ম গরে ওঠে। এই নাথ
পন্থা বৌদ্ধ মহাযান আর শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। অবিদ্যা ও অজ্ঞান থেকে মুক্তির
জন্য এবং মহাজ্ঞান লাভ করাই নাথগনের লক্ষ্য ছিল।সাধনার মাধ্যমে দেহ পরিশুদ্ধ করে
মহাজ্ঞান লাভের যোগ্য করলে তাকে পক্ক দেহ বলা হত। এই মতের প্রতিষ্ঠাতা মীননাথ। আর
শিব হল আদি নাথ। সব নাথ তার অনুসারী। দশম-একাদশ শতকে নাথধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ
করে। অই সময়ে নাথ সাহিত্য বিস্তার লাভ করে। প্রধান প্রধান নাথগন হলেন-
মীননাথ,গোরখনাথ,প্রমুখ।
বাউল
সাহিত্য
বাউল
মতবাদের উপর ভিত্তি করে রচিত সাহিত্যই হল বাউল সাহিত্য। বাউল সাধকদের সবচেয়ে বেশি
আলোচিত হচ্ছেন জগন্মোহন গোসাঁই ও লালন সাঁই। লালন তার বিপুল সংখ্যক গানের মাধ্যমে
বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন। এছাড়াও বাউল কবিদের
মধ্যে জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু সাঁই,
পাগলা কানাই, শীতলং সাঁই, দ্বিজদাস, হরিচরণ আচার্য, মনোমোহন দত্ত, লাল মাসুদ, সুলা
গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), রামু মালি, রামগতি শীল,
মুকুন্দ দাস, আরকুন শাহ্, সিতালং ফকির, সৈয়দ শাহ্ নূর, শাহ আব্দুল করিম, উকিল
মুন্সি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী,
আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার,
চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার, ক্বারী
আমীর উদ্দিন আহমেদ, ফকির দুর্বিন শাহ, শেখ মদন, দুদ্দু সাঁই,কবি জয়দেব, কবিয়াল
বিজয়সরকার, ভবা পাগলা, নীলকণ্ঠ, দ্বিজ মহিন, পূর্ণদাস বাউল, খোরশেদ মিয়া, মিরাজ
উদ্দিন পাঠান, আব্দুল হাকিম, মহিলা কবি আনোয়ারা বেগম ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
তাদের মাধ্যমেই বাউল মতবাদ বা বাউল সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করেছে।
মর্সিয়া সাহিত্য
মুসলমান সংস্কৃতির নানা বিষাদময়
কাহিনী তথা শোকাবহ ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে মর্সিয়া সাহিত্যের উদ্ভব হয়েছে।
মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি শেখ
ফয়জুল্লাহকে মনে করা হয়। তিনি ‘জয়নবের চৌতিশা’ নাম গ্রন্থটি রচনা করেন।
মর্সিয়া সাহিত্যের অন্যান্য কবিগণ
ছিলেন দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াত মামুদ, জাফর হামিদ।
গীতিকাঃ
আখ্যানমূলক লোকগীতি বাংলাসাহিত্যে
গীতিকা নামে পরিচিত।
“গীতিকা” – কে ইংরেজীতে বলা হয় Ballad, যা ফারসিতে Ballet বা নৃত্য শব্দ থেকে
এসেছে।
ময়নসিংহ গীতিকা ২৩ টি ভাষায় অনূদিত
হয়।
১৯২৩ সালে”মৈমনসিংহ গীতিকা” নামে সংকলন প্রকাশিত হয়।
“মহুয়া” পালাটির রচয়িতা দ্বিজ কানাই এবং”দেওয়ানা মদিনা” পালাটির রচয়িতা মনসুর
বয়াতি।
পুঁথি সাহিত্য
ó অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আরবি-ফারসি
শব্দ মিশ্রিত কাব্যকে দোভাষী পুঁথি বলে।
ó “ফকির
গরীবুল্লাহ” পুঁথি সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি।
ó পুঁথি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিগণ
হচ্ছেন- কবি কৃষ্ণরাম দাস, ফকির গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা।
ó পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় বৈশিষ্ট্য
হচ্ছে ইসলামী চেতনা সম্পৃক্ত।
ó দোভাষী বাংলা রচিত পুঁথি সাহিত্যকে
বলা হয় – বটতলার পুঁথি।
ó অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আরবি-ফারসি
শব্দমিশ্রিত এক ধরনের বিশেষ ভাষারীতিতে যে সব কাব্য রচিত হয়েছিল তা বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসে ‘পুথি সাহিত্য' নামে চিহ্নিত।
ó পুথি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবিগণ
হচ্ছেন- কবি কৃষ্ণরাম দাস, ফকির গরীবুল্লাহ, সৈয়দ হামজা।
ó পুথি সাহিত্যের প্রাচীনতম লেখক সৈয়দ
হামজা।
কবিওয়ালা ও শায়ের
ó কবিওয়ালা ও শায়েরের উদ্ভব আঠারো
শতকের মাঝামাঝি থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে।
ó আরবি-ফারসি-হিন্দি-উর্দু
ভাষার মিশ্রণে মুসলমানের কাব্য রচয়িতাদের বলা হতো -শায়ের।
ó কবিতাকে যারা জীবিকা নির্বাহের উপায়
হিসেবে গ্রহণ করত তাদের বলা হতো – কবিওয়ালা।
ó আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং উনিশ
শতকের প্রতমার্ধে রাষ্ট্রিক, আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক
বিপর্যয়ের মুখে কলকাতার হিন্দু সমাজে ‘কবিয়ালা’ এবং মুসলমান সমাজে ‘শায়ের’ এর উদ্ভব ঘটে।
ó এ কবিয়াল এবং শায়েররা যে সাহিত্য
রচনা করেছে তাকে দোভাষী সাহিত্য বলে।
ó গোজলা গুই হলেন কবিগানের আদিগুরু।
কবিগান
দুই পক্ষের তর্ক ও বিতর্কের মাধ্যমে
অনুষ্ঠিত গানকে কবিগান বলা হয়
কবিগানের আদিগুরু গোঁজলা গুই, শ্রেষ্ঠ রচয়িতা – হরু ঠাকুর।
কবিগান রচনা ও পরিবেশনায় বিশেষভাবে
সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন এন্টনি ফিরিঙ্গি ও রামপ্রসাদ রায়।
টপ্পাগানঃ
টপ্পাগান এর উদ্ভব- কবিগানের সমসাময়িককালে, হিন্দি টপ্পাগানএর আদর্শে।
বাংলা টপ্পাগানের জনক-নিধুবাবু
বা রামনিধি গুপ্ত।
আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার সুত্রপাত – টপ্পাগানথেকে
টপ্পাগানের রচয়িতা – কালী মির্জা ও শ্রীধর কথক
পাঁচালীগান
পাঁচালীগানের শক্তিশালী কবি দাশরথি
রায় দাশু রায়। তার পাঁচালী পালা প্রকাশ হয়েছিল দশ খন্ডে।
উল্লেখযোগ্য কিছু অনুবাদ সাহিত্য ও সাহিত্যিকের
নাম-
অনূদিত
গ্রন্থ |
অনুবাদকের
নাম |
মূল
রচয়িতা |
যে
ভাষা থেকে অনূদিত |
রামায়ণ |
কৃত্তিবাস
ওঝা |
বাল্মীকি |
সংস্কৃক
ভাষা |
মহাভারত |
কাশীরাম
দাস |
বেদব্যাস |
সংস্কৃক
ভাষা |
ইউসুফ-জুলেখা |
শাহ
মুহাম্মদ সগীর |
আব্দুর
রহমান জামী |
ফারসি
ভাষা |
লাইলী-মজনু |
বাহরাম
খান |
আব্দুর
রহমান জামী |
ফারসি
ভাষা |
পদ্নাবতী |
আলাওল |
মালিক
মুহাম্মদ জায়সী |
হিন্দি
ভাষা |
মধুমালতী |
সৈয়দ
হামজা |
মনঝন |
হিন্দি
ভাষা |
মধ্যযুগ-লোকসাহিত্য,যুগসন্ধিক্ষণ
ও প্রশ্নোত্তর
লোকসাহিত্য
ইংরেজীতে Folklore শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ
লোকসাহিত্য”।
জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত গান, কাহিনী, গল্প, ছড়া, প্রবাদ – লোকসাহিত্য।
লোকসাহিত্যের উপাদান জনশ্রুতিমূলক
বিষয় এবং প্রাচীনতম সৃষ্টি ছড়া।
“হারামণি” হলো প্রাচীন লোকগীতি, এর সংকলক- মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন।
ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য
লোককথাকে- রূপকথা, উপকথা এবং ব্রতকথা এই তিন ভাগে ভাগ করেছেন।
ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদাদার থলে প্রভৃতি জনপ্রিয় রূপকথার সংকলক – দক্ষিণারঞ্জনমিত্র মজুমদার।
পশুপক্ষীর চরিত্র অবলম্বনে রচিত
কাহিনীকে বলে – উপকথা যেমনঃ ঈশপের উপকথা।
মেয়েলী ব্রতে সঙ্গে সম্পর্কিত কাহিনী
অবলম্বনে রচিত লোককথাই – ব্রতকথা।
[১৭৬০ সালে ভারতচন্দ্র মারা যাবার পর মধ্যযুগের
সমাপ্তি হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে ভারত চন্দ্র মারা। যাবার সাথে সাথে মধ্যযুগের পতনের কি
সম্পর্ক? ভারতচন্দ্র মারা যাবার পর মধ্যযুগের সমাপ্তি হয় কারণ মঙ্গলকাব্যের চারশ
বছরের কাব্যধারার সমাপ্তি। কিন্তু এই কারনের সাথে আরও একটা কারণ
জড়িত .. রাজনৈতিক ভাবেও এই এলাকার পটভূমি পরিবর্তন হতে থাকে। ১৭৫৭ সালে পলাশির
প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হওয়ার মধ্যদিয়ে ইংরেজ তথা বৃটিশদের শাসন হয় তখন
সাহিত্যের আবির্ভাব হয় যা আধুনিক সাহিত্য ধারার প্রবর্তন করার অন্যতম কারণ]।
যুগসন্ধিক্ষণ (১৭৬১ -১৮৬০ খ্রী)
যুগসন্ধিক্ষণ মানে দুই
যুগের মিলন যুগ সন্ধিক্ষণ এমন একটি যুগ যে যুগে মধ্য যুগ এবং আধুনিক যুগের মিশ্র
বৈশিষ্ট পাওয়া যায়। যুগসন্ধিক্ষণের কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে
স্ববিরোধী কবি ও বলা হয়েছে। [স্ববিরোধী বলার কারণঃ প্রথমদিকে তিনি
ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে লেখলেও শেষের দিকে তার কাব্যে ইংরেজদের শাসনের প্রশংসা
করেছেন]।
অন্ত্য-মধ্যযুগঃ এ সময়টা নানা দিক থেকে
বাংলার অবক্ষয় যুগ এবং রাজনৈতিক দিক থেকে নবাবি আমল হিসেবে চিহ্নিত। এ সময় মুগল
সাম্রাজ্যের অবক্ষয়, বাংলার নবাবদের উত্থান-পতন, ইউরোপীয় বেনিয়া শক্তির আগ্রাসন
এবং কোম্পানি আমলের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে সাহিত্য সৃষ্টির স্বাভাবিক ধারা
ব্যাহত হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
সাহিত্য ক্ষেত্রে নবাবি আমলেরই জের চলতে থাকে। এ যুগেও তাই হিন্দু পৌরাণিক ও
ইসলামি ভাবসমৃদ্ধ পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ ইত্যাদি সাহিত্যের ধারা অব্যাহত
থাকে।
পদাবলিঃ আঠারো শতকে
যাঁরা পদ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: নরহরি চক্রবর্তী, নটবর দাস,
দীনবন্ধু দাস, চন্দ্রশেখর-শশিশেখর ও জগদানন্দ। এঁদের পদে অর্থ ও ভাবের বদলে চটুল ছন্দোবৈচিত্র্য
বা ঝঙ্কারের প্রাধান্যই বেশি। বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ক্ষণদাগীতচিন্তামণি এ সময়কার
একটি উল্লেখযোগ্য পদাবলি গ্রন্থ।
রামায়ণমূলক রচনাঃ এ সময়
‘রায়বার’ নামে এক বিশিষ্ট ধারার সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা রাজদ্বার বা
রাজস্ত্ততিকে বোঝাতো। এগুলি প্রকৃতপক্ষে রাজসভার স্থূল ও মুখরোচক কথোপকথন, যাকে
পরবর্তীকালের খেউড়-তরজার পূর্বরূপ বলা চলে। আরেকটি ধারা হলো তরণীসেনের যুদ্ধ
উপাখ্যান, যার সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি হিন্দুদের ভক্তিধর্মের প্রাবল্যের কারণে। এ
দুটি কাহিনী তখনকার বাঙালি-উদ্ভাবনা হিসেবে স্মরণীয়। এরূপ উপাখ্যানের প্রধান
রচয়িতা দ্বিজ দয়ারাম। রামানন্দ ঘোষের রামায়ণকাব্য (১৭৮০) এবং জগৎরাম রায়ের
অদ্ভুতরামায়ণও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাঁচালি কাব্যঃ বিদ্যাসুন্দরের
পাঁচালি বিদ্যাসুন্দর কাব্য অনেকটা রূপক বা আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত।
বিদ্যাসুন্দর কাহিনীর উৎস কাশ্মীরী পন্ডিত বিহ্লনের (১২শ শতক) চৌরপঞ্চাশৎ বলে
অনুমান করা হয়। এতে দেহভোগের প্রাবাল্য দেখা যায়। বাংলায় ষোলো শতকে দ্বিজ
শ্রীধর ও কবি কঙ্ক এবং সতেরো শতকে গোবিন্দদাস, কৃষ্ণরাম দাস, প্রাণরাম চক্রবর্তী ও
সাবিরিদ খান এ কাহিনী রচনা করেন। কাহিনীটি পরে ‘পালা’ হিসেবে কালিকামঙ্গলে যুক্ত
হয়।
মঙ্গলকাব্যঃ এ সময়ে
ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন বা শিবমঙ্গল বিশেষ
স্বাতন্ত্র্য লাভ করে। রামচন্দ্র যতির চন্ডীমঙ্গলও (১৭৬৬-৬৭) এ সময়ের উল্লেখযোগ্য
মঙ্গলকাব্য। ধর্মমঙ্গলের কবিরা হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী, নরসিংহ বসু, মাণিকরাম
গাঙ্গুলী, রামকান্ত রায়, সহদেব চক্রবর্তী প্রমুখ। ঘনরাম চক্রবর্তী ‘কবিরত্ন’
উপাধিতে ভূষিত হন এবং সাহিত্যে তাঁর স্থান ছিল ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদের পরেই। তাঁর ধর্মমঙ্গলে (১৭১১) উদার দৃষ্টিভঙ্গির
পরিচয় পাওয়া যায়। বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন নরসিংহ বসু।
মাণিকরাম গাঙ্গুলীর ধর্মমঙ্গলে (১৭৮১) ঘনরামের প্রভাব আছে। রামকান্ত রায়ের
ধর্মমঙ্গলে বর্ণিত আত্মকাহিনীতে নতুনত্ব এসেছে বেকারত্বের সঙ্গে কাব্য-উপলক্ষের
নাটকীয় বর্ণনায়। তাঁর কাব্যের রচনাকাল সম্ভবত ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ। এ সময় নতুন
দেবদেবীদের নিয়েও কিছু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়, যেমন: সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল,
শীতলামঙ্গল, লক্ষ্মীমঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সরস্বতীমঙ্গল প্রভৃতি। এগুলির মধ্যে
দুর্গাদাস মুখার্জীর গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী উল্লেখযোগ্য।
আঠারো শতকে মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র। তাঁর মাধ্যমে
একটা যুগের পরিণতি ঘটেছে। তাঁর প্রধান রচনা অন্নদামঙ্গল আটটি পালায় তিন খন্ডে
বিভক্ত: শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল ও
মানসিংহ-অন্নপূর্ণামঙ্গল। খন্ডগুলির মধ্যে অন্নদা একটি ক্ষীণ যোগসূত্র রক্ষা করেন,
যদিও তাঁর কৃপায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের ভাগ্যোদয়ের ঘটনাই এ
কাব্যের মূল বিষয়। বিদ্যাসুন্দরের রসালো কাহিনীটি আঠারো শতকের ধারা ও রুচির
পরিচায়ক। তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থ হলো সত্যনারায়ণের
পাঁচালি, রসমঞ্জরী এবং সংস্কৃতে রচিত নাগাষ্টক ও গঙ্গাষ্টক।
অন্নদামঙ্গল পরবর্তীকালের কবিদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে।
কালিকামঙ্গলের কবিরা একে ব্যাপকভাবে অনুকরণ করেন। তাছাড়া প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনায় হ্যালহেড (১৭৭৮) ও লেবেদেফ (১৮০১) এবং
বাংলা অভিধান রচনায় (১৭৯৯-১৮০২) ফরস্টার অন্নদামঙ্গলের ভাষারই উদাহরণ
দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে অন্ত্য-মধ্যযুগে উঁচুমানের সাহিত্য ভারতচন্দ্রের হাতেই
সৃষ্টি হয়েছে। ছন্দের চমৎকার প্রয়োগ, বিশাল শব্দসম্ভার, পদরচনায় লালিত্যগুণের
সঞ্চার ইত্যাদি কারণে তাঁর কাব্য অনুপম হয়ে উঠেছে।
রামপ্রসাদ সেন ক্ষয়িষ্ণু যুগের কৃত্রিমতার মধ্যে বিশিষ্ট হয়ে
ওঠেন তাঁর আন্তরিক ভক্তি ও সরল বাচনভঙ্গির জন্য। শাক্তপদাবলির কবি হিসেবে তাঁর
শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হলেও তিনি বিদ্যাসুন্দর কাহিনী এবং কৃষ্ণকীর্তনও রচনা করেন।
যে গানের জন্য রামপ্রসাদের এই শ্রেষ্ঠত্ব তাতে রয়েছে ঘরোয়া ভাবের ছোঁয়া এবং
আধ্যাত্মিক ব্যাকুলতা। তাঁরই গানে ভয়ঙ্করী কালীদেবী হয়ে ওঠেন দয়াময়ী জননী।
লোকগাথা আঠারো শতকের
অন্যতম সাহিত্যধারা। এর প্রধান বিষয় প্রণয়কাহিনী। অধিকাংশ লোকগাথাই ছিল অলিখিত,
লোকমুখে প্রচলিত; ফলে সেগুলির ভাব, ভাষা ও উপমায় প্রক্ষেপণ ঘটেছে উনিশ শতক
পর্যন্ত গাথাগুলির প্রায় সবটিতেই নারীর ভূমিকা প্রধান। এ ধারার সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য হলো মৈমনসিংহ-গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ-গীতিকা।
গীতিকাগুলির কালনির্ণয় দুরূহ। প্রথমটি দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) ও দ্বিতীয়টি
চন্দ্রকুমার দে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। এগুলিতে
পল্লীর লোকজীবন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
অবক্ষয়িত সমাজ-মানসের বিস্রস্ত রুচির প্রকাশ ঘটে পাঁচালি,
যাত্রা, তরজা, কবিগান ইত্যাদিতে।
বাংলায় পাঁচালি গানের প্রচলন ছিল বহু আগে থেকেই। যাত্রার উদ্ভব হয় দেবদেবীদের
বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এবং কৃষ্ণলীলা ছিল এর মূল বিষয়; পরে অবশ্য বিদ্যাসুন্দর
কাহিনীও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। তরজার প্রচলন হয় চৈতন্যদেবের সময় থেকে এবং অবক্ষয়কালে
তা হয়ে যায় উত্তর-প্রত্যুত্তর ঢঙের ছড়াগান। এ থেকে আবার আসে কবিগান, যা দুটি পক্ষের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। এরই
চরম রূপ হচ্ছে খেড় বা খেউড়।
যুগ-পরবির্তন সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে জারি গান, সারি গান ইত্যাদি
লোকগীতির ধারা সচল থাকে; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক সংস্কৃতির প্রভাবে
পাঁচালি-কীর্তন ঢঙ বদলে আখড়াই ও পরে হাফ-আখড়াইতে পরিণত হয়। এই বিস্রস্ত ধারার মধ্য দিয়েই
চলে আসে যুগান্তর।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর
1) বাংলা সাহিত্যের
মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন কি?
= শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন।
2) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকাব্য কে রচনা করেন?
= বাড়ু চন্ডীদাস।
3) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য কোন যুগের নিদর্শন?
= চৈতন্যপূর্ব যুগ।
4) বাড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য কে উদ্ধার করেন?
= বসন্তরঞ্জন রায়, ১৯০৯।
5) শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য কোথা থেকে উদ্ধার করা হয়?
= পশ্চিম বঙ্গের বাকুড়া জেলার কাকিলা গ্রামের এক গৃহস্থ বাড়ীর গোয়ালঘর থেকে
উদ্ধার করেন।
6) বৈষ্ণব পদাবলীর আদি রচয়িতা কে?
= বাড়ু চণ্ডীদাস।
7) আদি যুগে লোকজীবনের কথা বিধৃত সর্বপ্রথম সাহিত্যক নিদর্শন কোনটি?
= ডাক খনার বচন।
৪)
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যর প্রধান দুটি ধারা কি?
= ১। কাহিনীমূলক ও ২।
গীতিমূলক।
9) শ্রী চৈতন্যর নামানুসারে মধ্যযুগের বিভাজন কিরূপ?
= চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ), চৈতন্য যুগ (১৫০১-১৬০০) ও চৈতন্য
পরবর্তী যুগ (১৬০১-১৮০০)
10) চৈতন্য পরবর্তী যুগ বা মধ্যযুগের শেষ কবি কে?
= ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর।
11) আধুনিক যুগের উদগাতা কে?
= মাইকেল মধুসুদন দত্ত।
12) কোন যুগকে অবক্ষয়ের যুগ বলা হয়?
= ১৭৬০-১৮৬০সাল পর্যন্ত।
13) বাংলা সাহিত্যর আধুনিক যুগের সময়কাল কয়পর্বে বিভক্ত ও কি কি?
= চারটি পর্বে বিভক্ত। যেমন ১. প্রস্তুতি
পর্ব (১৮০১-১৮০৫)খ্রিঃ,
২. বিকাশ
পর্ব (১৮৫১-১৯০০) খ্রিঃ,
৩.রবীন্দ্র
পর্ব (১৯০১-১৯৪০) খ্রিঃ ও
৪. অতি-আধুনিক যুগ (১৯০১ বর্তমান কালসীমা)।
14) আধুনিক যুগ কোন সময় পর্যন্ত বিস্তৃত?
= ১৮০১ সাল থেকে বর্তমান।
15) যুগ সন্ধিক্ষনের কবি কে?
= ঈশ্বরচন্দ্র দত্ত।
16) বাংলা ভাষায় রামায়ন কে অনুবাদ করেন?
= কৃত্তিবাস।
17) রামায়নের আদি রচয়িতা কে?
= কবি বাল্মীকি।
18) বাংলা ভাষায় মহাভারত কে অনুবাদ করেন?
= কাশীরাম দাস।
19) মহাভারতের আদি রচয়িতা কে?
= বেদব্যাস।
20) গীতি কাব্যের রচয়িতা কে?
= গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস।
21) পুঁথি সাহিত্যের প্রথম সার্থক কবি কে?
= ফকির গরিবুল্লাহ।
22) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কে?
= মুকুন্দরাম চক্রবর্তী।
23) বাংলা গদ্যের জনক কে?
= ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
24) আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ প্রতিভু কে?
= বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
25) বাংলা ভাষার আদি কবি?
= কানা হরিদত্ত।
26) বাংলা গদ্যর উৎপত্তি কোথায়?
= আঠার শতকে।
27) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর প্রাচীনতম শাখা কোনটি?
= কাব্য।
28) বাংলা গদ্য সাহিত্য কখন শুরু হয়?
= আধুনিক যুগে।
29) আলাওল কোন যুগের কবি?
= মধ্য যুগের।
30) মধ্যযুগের অবসান ঘটে কখন?
= ঈশ্বর গুপ্তের মৃত্যুর সঙ্গে।
31) উনিশ শতকের সবচেয়ে খ্যাতনামা বাউল শিল্পী কে?
= লালন শাহ।
32) কাঙ্গাল হরিনাথ কখন আবির্ভূত হন?
= উনিশ শতকের শেষার্ধে।
33) বিষাদসিন্ধু কোন যুগের গ্রন্থ?
= আধুনিক যুগের।
34) মধ্যযুগের অন্যতম সাহিত্য নিদর্শন কি?
= পদ্মাবতী ও অন্নদামঙ্গল।
35) চন্ডীদাস কোন যুগের কবি?
= মধ্যযুগের।
36) আধুনিক বাংলা গীতি কবিতার সূত্রপাত?
= টপ্লাগান।
37) টপ্পা গানের জনক কে?
= নিধুবাবু (রামনিধি
গুপ্ত)
38) মীর মশাররফ সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন?
= উনিশ
শতকের শেষার্ধে।
বাংলা
সাহিত্যের প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরঃ
১. বাইশা কী :- মনসামঙ্গল কাব্যের
২২জন ছোট-বড় কবি।
২. কোন মহাপুরুষ একটি বাংলা পংক্তি না লিখলেও তাঁর নামে একটি যুগের সূচনা হয়েছে
:- শ্রীচৈতন্যযুগ।
৩. চৈতন্য যুগের ব্যাপ্তি :- ১৫০১- ১৬০০
৪. কড়চা ‘ শব্দের শাব্দিক অর্থ :- ডায়রি বা দিনলিপি। (বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য জীবনী
গ্রন্থ কড়চা নামে পরিচিত)
৫. নবীবংশ, রসুলবিজয় -জীবনীগ্রন্থের রচয়িতা কে :- সৈয়দ সুলতান।
৬. নাথ সাহিত্যের প্রধান কবি :- শেখ ফয়জুল্লাহ।
৭. তাঁর রচিত নাথ সাহিত্য :- গোরক্ষবিজয়।৮. “মর্সিয়া” শব্দটি আরবি, এর অর্থ :- শোক
বা আহাজারি।
৯. মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি :- শেখ ফয়জুল্লাহ।
১০. ফয়জুল্লাহ রচিত মর্সিয়া সাহিত্যকর্ম :- ‘জয়নবের চৌতিশা ‘
১১. দৌলত উজির বাহারাম খানের প্রথম কাব্য :- জঙ্গনামা বা মক্তুল হোসেন। (এটি মর্সিয়া
সাহিত্য। কারবালার যুদ্ধবিগ্রহ এই কাব্যর বিষয় বস্তু।)
১২. বাংলায় অনুবাদ কাব্যের সূচনা হয় কোন যুগে :- মধ্যযুগ। ১৩. মধ্যযুগে অনুবাদ কাব্যের প্রথম জয়যাত্রা শুরু করেন:- কবি কৃত্তিবাস
ওঝা।
১৪. বাল্মিকী রচিত রামায়নের প্রথম অনুবাদক :- কৃত্তিবাস।
১৫. রামায়নের প্রথম মহিলা অনুবাদক :- চন্দ্রাবতী। (চন্দ্রাবতীর পিতা ছিলেন ‘মনসামঙ্গল
‘ কাব্যের রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাস। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জ। চন্দ্রাবতী বাংলা সাহিত্যের
প্রথম মহিলা কবি।)
১৬. কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের প্রথম অনুবাদক :- কবীন্দ্র পরমেশ্বর।
(আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের উৎসাহে এই কাব্য রচনা করেন বলে কাব্যটি
‘পরাগলী মহাভারত’ নামে খ্যাত।
১৭. মহাভারতের সবচেয়ে প্রাঞ্জল ও জনপ্রিয় অনুবাদ করেন :- কাশীরাম দাস।
১৮. রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান ধারার প্রথমকবি :- শাহ মুহাম্মদ সগীর।( তিনি বাংলা সাহিত্যের
প্রাচীনতম মুসলমান কবি)
১৯. ফারসী প্রেমাখ্যান ‘ইউসুফ-জুলেখার’ অনুবাদক :- শাহ মুহাম্মদ সগীর।২০. বাংলা সাহিত্যে
‘রোসাঙ্গ’ বা ‘রোসাং ‘ নামে উল্লেখ করা হয়েছে :- আরাকানকে।
২১. আরাকানের অধিবাসীদের বলা হয় :- “মগ”
২২. আরাকান রাজসভার প্রথম বাঙ্গালী কবি :- দৌলত কাজী। (তাঁর রচনা:- সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী-১ম
ও ২য় খন্ড)
২৩. আরাকান রাজসভার শ্রেষ্ঠ কবি:- ‘আলাওল’
২৪. আলাওলের সাহিত্যকর্ম :- হপ্তপয়কর, সিকান্দরনামা, তোহ্ফা, “পদ্মাবতী “, সতীময়না
ও লোরচন্দ্রানী-৩য় খন্ড)
২৫. “চন্দ্রাবতী ” কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা :- কোরেশী মাগন ঠাকুর।
২৬. আরবী লোকগাঁথা “লায়লী-মজনু”কাব্যের রচয়িতা :- দৌলত উজীর বাহারাম খান। ২৭. শ্রীকৃষ্ণবিজয়”
কাব্যের রচয়িতা :- মালাধর বসু (তাঁর খেতাব :- গুনরাজ খান)
২৮. কোন সময়কে পুঁথি সাহিত্যের (এটি বটতলার সাহিত্য নামেও পরিচিত) স্বর্ণযুগ বলা হয়
: ১৭৬০ থেকে ১৮৬০।
২৯. পুঁথি সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক ও জনপ্রিয় কবি :- ফকির গরীবুল্লাহ। (আদি কবি
: গুজলা গুঁই)
৩০. তাঁর রচিত পুঁথি সাহিত্য :-ইউসুফ জুলেখা, আমীর হামজা, জঙ্গনামা, সত্যপীরের পুঁথি)
৩১. মধুমালতী, জৈগুনের পুঁথি, আমীর হামজা (২য় অংশ)– এই পুঁথি সাহিত্যগুলোর রচয়িতা
:- সৈয়দ হামজা।
৩২. ফরাসী শব্দ ‘Ballad ” এর অর্থ :- গীতিকা ( Ballet অর্থ ‘নৃত্য ‘)
৩৩. লোকের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনী, গান, ছড়া, ইত্যািকে বলা হয় :- লোক সাহিত্য।
৩৪. বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত লোকগীতিকাগুলোকে কয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে: ৩ ভাগে। (নাথ,
মৈমনসিংহ, পূর্ববঙ্গ গীতিকা)
৩৫. মৈমনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক :- ড. দীনেশচন্দ্র সেন।
৩৬. মৈমনসিংহ গীতিকা কয়টি ভাষায়
অনুদিত হয় :- ২৩ টি ভাষায়।***উল্লেখযোগ্য মৈমনসিংহ গীতিকা:-
ক. মহুয়ার পালা :-দ্বিজ কানাই,
খ. দেওয়ানা মদিনা :- মনসুর বয়াতি এবং কাজলরেখা।
৩৭. নাথগীতিকা :- ‘মানিকচন্দ্র
রাজার গান’ :- সংগ্রাহক :- স্যার জর্জ গিয়ার্সন (রংপুর থেকে)
৩৮. পূর্ববঙ্গ গীতিকা:- নিজাম ডাকাতের পালা, কাফনচোরা।
৩৯. পশুপাখির চরিত্র অবলম্বনে যেসব কাহিনী গড়ে উঠেছে তার নাম :- উপকথা।
৪০. “বারমাস্যা ” বলতে কি বোঝানো হয় :- যে কবিতায় নায়িকার জীবনের বারো মাসের সুখ
দুঃখের কাহিনী বর্ননা করা হয়।
৪১. অবক্ষয় যুগের ব্যাপ্তি :- ১৭৬০থেকে ১৮৬০
৪২. যুগসন্ধিক্ষনের কবি :- ইশ্বরচন্দ্রগুপ্ত (তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক।
তাঁর রচিত কবিতা:- ‘কে’।)
সূত্রঃ- সাহিত্যের বিভিন্ন বই
ও শিক্ষা সহায়ক ওয়েব সাইট থেকে সংগৃহীত। (copyright law, 2000)
কোন মন্তব্য নেই